অবশেষে ভূবন বাদ্যকরের দাদাগিরি(Dadagiri of Bhuban Badyakar)। দাদা সৌরভ গাঙ্গুলী সহ সমস্ত প্রতিযোগী এবং আপামর দর্শকদের তাক লাগিয়ে গত শনিবারের(20/02/2022) দাদাগিরি এপিসোডে জয়ী ভুবন বাদ্যকর(Bhuban Badyakar)। প্রশ্ন আসতে পারে তিনি কি নিজের যোগ্যতায় জিতেছেন, না’কি জিতিয়ে দেওয়া হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর যাই আসুক টেলিভিশন কোম্পানি তাকে সেলিব্রটির পর্যায়ে স্থান দিয়ে ভূবন বাবুকে নিয়ে দাদাগিরির পুরো এপিসোডটা ব্রডকাস্ট করলো- এটাও বেশ রোমাঞ্চকর। ভূবন বাদ্যকর(Bhuban Badyakar) যে সকলকেই ব্যাবসা করার এক সুযোগ করে দিয়েছে সেটা অস্বীকার করার উপায় কারোর নেই।
কাঁচা বাদাম, কাঁচা বাদাম- পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা ভারতবর্ষে এখন কাঁচা বাদামে মেতেছে। শুধু ভারত’ই বা কেন, বাংলাদেশের মানুষজনও কাঁচা বাদামে ঘায়েল। সোশ্যাল মিডিয়া যখন কারো উপর সদর্থক ভাবে সদয় হয়, কোনোভাবেই তা রোধ করার উপায় থাকেনা। হুয়াই দিস কোলাবরি, টুম্পা, টুনিরমা থেকে শুরু করে রানু মন্ডলের গান এবং ভিডিও রাতারাতি একজন মানুষকে বিখ্যাত করে দেয়। তা 10 বছর আগে হলে অবাক হতে হতো। তবে বর্তমানে অবাক হওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়।
কিন্তু আবারও বাঙালি একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের, মাটির সঙ্গে থাকা, মাটির সঙ্গে ঘর করা মানুষকে নিয়ে মেতেছে। নাম ভুবন বাদ্যকর, গ্ৰাম- কুড়িগ্রাম, পোস্ট- থানা- দুব্রাজপুর, জেলা- বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। ভূবন বাবু একজন শ্রমিক, দিনমজুর। কিন্তু তার বাইরেও তিনি অন্নসংস্থান ও পারিবারিক আর্থিক সংকট দূর করার জন্য বাদাম বিক্রি করেন। ভাজা নয়, খোসা ছাড়ানো বাদামও নয়, খোসাসহ কাঁচা বাদাম।
কাঁচা বাদাম বিক্রেতা বাদাম বিক্রির সাথে নিজেকে এমন ভাবে জড়িয়ে ফেলেছেন যে প্রকৃতিগত স্বভাবসুলভ বসে কাঁচা বাদাম নিয়ে গান রচনা ও সুরারোপ করে ফেলেছেন। নিজে গান গেয়ে বাদাম বিক্রি করতে থাকেন। এ রোজকার ঘটনা। এর মধ্যে কে যেন তার গান গেয়ে কাঁচা বাদাম বিক্রি করার ভিডিও তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে দেন। ব্যস তাতেই ভূবন বাদ্যকর ভাইরাল। প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ নিতান্তই গরিব দিন মজুর কাঁচা বাদাম বিক্রেতা হয়ে উঠল জাতীয় চরিত্র থেকে আন্তর্জাতিক চরিত্র।
কাঁচা বাদাম গানের লিরিক | Lyrics of kacha badam-
বাদাম বাদাম দাদা কাঁচা বাদাম,
আমার কাছে নাইকো বুবু ভাজা বাদাম,
আমার কাছে পাবে শুধু কাঁচা.. বাদাম।
এই,
বাদাম আছে ভালো মাথার ছিড়া চুল,
সিটি গোল্ডের চুড়ি মালা দিয়ে
মোবাইলের বডি ভাঙা দিয়ে বাদাম।
মোবাইলের বডি গুলো পাঁচ টাকা দাম
পায়ে তোড়া হাতের বালা থাকে যদি সিটি গোল্ডের চেন,
দিয়ে যাবেন,
তাতে সমান সমান তোমরা বাদাম পাবেন।
বাদাম বাদাম দাদা কাঁচা বাদাম,
আমার কাছে নাইকো বুবু ভাজা বাদাম,
আমার কাছে পাবে শুধু কাঁচা.. বাদাম।
কাঁচা বাদাম কেন ভাইরাল?-
ভাইরাল হওয়ার প্রকৃত কোন নির্দিষ্ট কারণ নেই। তার অর্থ এই নয় যে তার মধ্যে মন ছুঁয়ে ফেলা মৌলিকত্ব থাকবে না। মানুষের চাহিদা পছন্দ ইত্যাদি সাধারণ কিছু কারণ থাকলেও, কখনো বিতর্কিত মন্তব্য, নিজেকে প্রচার বা জাহির করার নানান পন্থাও ভাইরাল করে দেয়। আবার একেউ অস্বীকার করা যায় না, মানুষ কোন বিষয়টিকে বিনোদন বা শিক্ষার জন্য খুঁজছে। তবে কাঁচা বাদামের ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে-
গানের কথা লিরিক-
কাঁচা বাদাম গানের লিরিক্স খুবই সাংঘাতিক। সাংঘাতিক অর্থে এই নয় যে, গানটি দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আমাদের তাড়া করছে। অসাধারণ, সাংঘাতিক কথাগুলি পাশাপাশি বসে দারুন একটি কাব্যিক ফর্ম তৈরি করেছে।
প্রথাগত কবি-সাহিত্যিকদের কাছে হয়তো এই লিরিকের কোন গুরুত্ব নেই। কিন্তু স্বভাবসুলভ বসে নিজের কাজের প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং আত্মনিয়োগ কঠোর বাস্তব, সভাবিক কথাগুলো আপনি ছন্দবদ্ধ হয়েছে। ব্যাকরণের নির্ধারিত নিয়মের বোঝা মাথায় চাপিয়ে অযাচিত ভার বহনের অস্বীকারও কাংচা বাদাম জন্ম নিয়েছে প্রকৃতিগত স্বভাবসুলভে।
কাঁচা বাদামের সঙ্গীতায়ন-
কেবশমাত্র কথা বা শব্দগুলি ভাইরাল করতে সাহায্য করেনি। কাঁচা বাদাম সংগীতের রূপ দেওয়াটাও অসাধারণ। প্রত্যহ মৌলিকত্বকে সেকার করে সুরারোপিত কাচা বাদাম গান শুনে মনে হয় না কোন অপেশাদার ব্যক্তির সৃষ্টি। গানটি যদি কলকাতার কোন শিল্পীর কন্ঠে গাওয়া হতো এবং তার চিত্র পরিবেশিত হত, কি হত বলা যায়না। হয়তো তখন তা চিরাচরিত প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ তারা পরিবেশনের ফলে সমাজে স্থান পেত।
তাহলে কি এখনো গানটি কুলীন সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়? কেননা অনেক ইউটিউব ভিডিও ক্রিয়েটর, ফেসবুক ভিডিও ক্রিয়েটররা গানটি নিয়ে নিজেদের মতো করে মজাদার ভিডিও তৈরি করে লাখ লাখ ভিউয়ার পাচ্ছেন।
কতশত সাংবাদিক তার খবর প্রকাশ করে জনগণের বাহবা কুরোচ্ছেন। এক্ষেত্রে তার সংসারী অনটন সারা বিশ্বের কাছে অবগত হচ্ছে। সাহায্য আসতে শুরু করেছে। কিন্তু এর পরিধি কত দূর ভবিষ্যৎ বলবে।
বাদাম বাদাম- তাল লয়-
ভূরন বাদ্যকরের কন্ঠে তার সুরারোপিত গানটি শুনে মনে হয়না তিনি তাল, ছন্দ সম্পর্কে উদাসীন। গানটি সাধারণভাবে মধ্যম কাহারবা তালের গান। পরিবেশনের জনসাধারণকে মাতিয়েছে, একেবারে খাপে খাপ মিলে যাওয়াতে ভিডিও ক্রিয়েটররা গানটিতে প্রি ক্রিয়েটেড তাল ব্যবহার করেছেন। যদিও এক্ষেত্রে গানটির স্বাভাবিক মাটির গন্ধটা যেন উবে গেছে। অবশ্য এগুলোকেও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। নিষ্পাপ বদ্ধ ঘরের মধ্যে বন্দী ভূবন বাদ্যকরের তা নিয়ে কোনো হেলদোল নেই। তবে ভিডিও ক্রিকেটারদের মধ্যে শুরু হয়েছে সাংঘাতিক প্রতিযোগিতা। কার ভিডিওটি লোক সবচেয়ে বেশি দেখছে, কে কিভাবে তা গ্রহণ করছে, সেটা বিষয় নয়। বিষয় হলো ভিউয়ারের সংখ্যা এবং দেখার সময়সীমা বৃদ্ধি।
লোক সংস্কৃতির সাথে আধুনিকতা, ডিজিটাল শব্দের প্রয়োগ-
ভূবন বাদ্যকর সাদামাটা চেহারার সৌন্দর্য, তার বাড়ির কাঠামো নিষ্পাপ মানসিকতা, অভাব ইত্যাদির সঙ্গে মাটির সোঁদা গন্ধ, অন্যদিকে সিটি গোল্ড, মোবাইল, পায়ের তোরা ইত্যাদির মতো শব্দগুলির স্বাভাবিক সহাবস্থান অজান্তেই একে অপরের সাথে মিলনের অঙ্গীকারবদ্ধ। ডিজিটাল সামগ্রী ও ডিজিটাল দুনিয়া যে কেউ তার চলার পথের সঙ্গী করেছে।
নিষ্পাপ ভূবন বাদ্যকর | Innocent Bhuban Badyakar-
নিষ্পাপ ভূবন বাদ্যকর। অবশ্য সর্বসাধারণের একটু বোঝা কঠিন হবে যদি নিষ্পাপ শব্দের বদলে আমরা ইনোসেন্ট শব্দটি ব্যবহার করি। তাহলে পরিষ্কার হয়ে যায় আমরা কি বলতে চাইছি।
ভূবন বাদ্যকরের দশের বেশি ইন্টারভিউ আমরা দেখেছি। ভিডিও ক্রিয়েটর থেকে শুরু করে সাংবাদিক পর্যন্ত সকলের কাছেই যাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছেন অতি সাধারন ভাবে। কপিরাইট ভিডিও থেকে রোজগার কিভাবে হয়, এর সম্বন্ধে সত্যিই ভূবন বাবুর কোন ধারণা আছে বলে আমাদের জানা নেই। তাকে যে যেভাবে বলেছেন সেভাবে তিনি বুঝছেন। তাই কখনও তিনি থানায় যাচ্ছেন, কখনো সাংবাদিকদের বলেছেন। তার গান যে এত ভাইরাল তার জন্য তাকে যেন ক্রিয়েটররা টাকা দেয়।
কিন্তু প্রকৃত রাস্তা কোথায়? কিভাবে তাদের কাছে পৌঁছানো যায়? সে স্থানে পৌঁছানো কত দুঃসাধ্য- তা কিন্তু কিছুই জানে না। কিন্তু যারা তার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন তারা সকলেই দুঃসাধ্য সাধনের কঠিন রাস্তা সম্বন্ধে বেশ ভালোভাবেই জানেন। তাই তো পুররায় ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে আবারও তাকে দিয়ে গানটি গাওয়ানো, সেটাই সোশ্যাল মিডিয়া আপলোড করছেন। এক্ষেত্রে ভূবন বাবু কত টাকা পাচ্ছেন জানা আছে কি?
অর্থাৎ ভূবন বাদ্যকর বার বার একই ফাঁদেই পা দিচ্ছেন। তার তো কোন ইউটিউব চ্যানেল নেই। তার তো কোনো ফেসবুক একাউন্ট নেই, যে প্লাটফর্মে তিনি নিজে নিজেই তার গানের ভিডিও গুলি আপলোড করবেন। তার হিতাকাঙ্খী হলে না এ ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য কে এগিয়ে এলেন।
ভাইরাল ভিডিওর স্থায়িত্ব-
ভাইরাল কোন বিষয়, যেমন গান, ভিডিও, বিতর্কিত বিষয়ে দীর্ঘস্থায়িত্ব সম্ভাবনা কম। অর্থাৎ ভবিষ্যতে দীর্ঘ দিন ব্যাপী কাউকে ভাইরাল রাখেনা। ভাইরালের মুহূর্তটিকে সুচারুভাবে ব্যবহার করলে এধরনের মানুষের ক্ষেত্রে কিছুটা আর্থিক সাহায্য হয়। কেননা একটা ভাইরাল ঘটনা ঠিক তার পূর্ববর্তী ভাইরাল ঘটনাকে চাপা দিয়ে নতুন করে তার চলার পথকে প্রশস্ত করে। তাই বলতে পারি যতদিন না আগামী দিনের কোন ভাইরাল ভিডিও আছে, ততদিন পর্যন্ত ভূবন বাদ্যকরের কাঁচা বাদাম গানের ভিডিও ভাইরাল হয়ে থাকবে। ভূবন বাদ্যকরের গানের ভিডিও ভবিষ্যতে ভাইরাল ভিডিও তলায় চাপা পড়ে যাবে। এর মধ্যে যে বা যারা কামাবার কামিয়ে নেবেন। চালাক চতুরহীন অভাবী ভূবন বাবু এই সময়কে কিভাবে ব্যবহার করবেন জানা নেই।
শোনা যাচ্ছে এবং দেখাও যাচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা রাজনৈতিক নেতা সাংবাদিকরা নানাভাবে সম্মাননা, সম্বোধন জানাচ্ছেন, ছবি তুলছেন, ভিডিও বানাচ্ছেন, সোশ্যাল মিডিয়া আপলোড করছেন। এতে খুশি অতিসাধারণ নিম্নবিত্ত চাহিদার ভূবন বাবু। তার বাড়িতে শান্তি আনুক, ভিড় করে আধুনিক মানুষের প্রশ্নবানে তিনি কতটা সুখে আছেন? তবে সাধারণ সূত্র বলে তার ঘুমের বারোটা বেজে গেছে।
ভূবন বাদ্যকরের দাদাগিরি সার্থক হোক | May Dadagiri be Successful-
আমরা চাইবো ভুবন বাবুর গানটি কপিরাইট কোন সহৃদয় ব্যক্তি অথবা সংস্থা কিনুক। কোন ব্যান্ডেড কোম্পানির সহযোগিতায় প্রকাশ করুন আপনাদের নিজেদের মতো করে। ভবিষ্যতে ভুবন বাবুর কোন গান আর ভাইরাল হবে কি’না জানিনা। কিন্তু কপিরাইট কেনার মধ্যে তার সাংসারিক আর্থিক অনটন দূর করার প্রয়াস করাকেও কোনো অর্থেই খাটো করা কারো অধিকার নেই।
আপনাদের গাঁদাফুল গানটির কথা মনে আছে। যে গানটি ওপর ভিডিও করে বাদশা কত টাকা কামিয়েছে হিসাব নেই। প্রথমদিকে গানটির গীতিকার রতন কাহার কিছুই জানতেন না। পরবর্তীকালে জানলেন এবং তার আবেদন সোশ্যাল মিডিয়া সহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের মধ্য দিয়ে বাদশা কানে পৌঁছালে, বাদশা রতন কাহারকে কপিরাইটের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন এককালীন। সে সূত্র ধরে আমাদের আবেদন- কোন সংস্থা, কোন সেলিব্রেটি গানটি নিয়ে ভিডিও করুন এবং ভুবন বাদ্যকরকে সামান্য সাহায্য করার জন্য আসুন। আপনারা অর্থ উপার্জন করুন, ভূবন বাবুকেও আইনি ও নৈতিকভাবে অর্থোপার্জনের সাহায্য করুন। ধন্যবাদ।