মে দিবস পেরিয়ে গেল। আবার একটা ছুটিও গেল। শ্রমিকদের আত্মসম্মান, বিশ্বাস, আস্থা, বিশ্রাম, আনন্দ,স্বস্তি। মে দিবসের সঠিক স্লোগান ও পোস্টার(What should be the Proper Poster for Labourday in this contemporary situation) বর্তমানে কি হওয়া উচিৎ এবং এই দিনটির বর্তমানের গুরুত্ব রয়েছে, কি নেই, তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এই লেখায় আপনাদের সামনে তুলে ধরব। আচ্ছা আপনাদের কি মনে হয় না, মে দিবসের গুরুত্ব কমে গেছে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে মে দিবস- কারখানা দীর্ঘক্ষণ কাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন। ষোল থেকে কুড়ি ঘন্টা পর্যন্ত অমানুষিক কাজের সময়সীমা। দিনের বেশিরভাগ সময় কারখানার কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকা।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অন্যান্য কাজের জন্য বেঁচে থাকার সামান্য সময় নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার প্রতিবাদ। তার ওপর যৎসামান্য মজুরি, থাকার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ইত্যাদি ছিল শ্রমিকদের পাওনা। এরই প্রতিবাদে আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর পূর্বে(১৮৬৯) আমেরিকার শিকাগো শহরে আন্দোলন যে শ্রমিক দিবসের জন্ম দিয়েছিল বর্তমানে সারা পৃথিবী জুড়ে পালিত হয়ে আসছে, কিন্তু কালের চক্রে শ্রমিকদের অবস্থা পুনরায় যেন সেই আগের মতই ফিরে এসেছে।
সরকারি কর্মচারী ব্যতিরেকে বেশিরভাগ প্রাইভেট কোম্পানি শ্রমিকদের অন্তত 12 ঘন্টা কাজ করে। এর মধ্যে সুন্দর একটা চালাকির আশ্রয় তৈরি হয়েছে। নতুন নিয়ম 8 ঘন্টা কাজ করো। 8 ঘন্টার জন্য একরকম, 12 ঘন্টার জন্য আরেকরকম 16 ঘণ্টার জন্য অন্য রকম। 12 ঘন্টার ক্ষেত্রে চার ঘণ্টার ওভারটাইম এবং এই অফারটা সাংঘাতিক চতুরতা সৃষ্টি করে। আইনি ফাঁকফোকরের শূন্যস্থান পূরণ করার আপ্রান চেষ্টা। কোন বিপদ নেই, ঝুঁকি নিয়ে জটিলতা নেই।
কেন মালিকরা এখনও শ্রমিকদের ভয় দেখিয়ে চলেছে?-
শ্রমিকদের ভয় দেখানোর অনেক অস্ত্র মালিকদের হাতে। বিশেষত শ্রমিকদের দুর্বল স্থানগুলি সম্পর্কে মালিকরা যথেষ্ট সচেতন। তারা জানে শ্রমিকদের কোন স্থানে টোকা দিলে কি আওয়াজ, কেমনভাবে বের হবে। তাই তদের হাতে সম্পুর্ণ নিয়ন্ত্রনের সুতো। বিশেষভাবে নিচের কারণগুলির দিকে নজর দিলে কিছুটা পরিষ্কার হবে আশা রাখি।
বেকারত্ব, কাজের অভাব-
কাজের অভাব, বেকারত্ব। নৈমিত্তিক ব্যবহার্য দ্রব্যাদির আকাশছোঁয়া দাম। ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ। এরপর রয়েছে ওষুধপত্রের খরচ। শ্রমিকদের অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে এনে দেয়। তারা কাজ করতে চায়। মজুরি পেতে চায়। যদি দুটো টাকা বাড়তি রোজগার হয় তা দিয়ে বাড়তি কিছু সুরাহা হয়। আর এখানেই মালিকপক্ষের জয়। শ্রমিকদের দূর্বলতাকে আধার করে বাড়তি কাজ করিয়ে নেওয়ার প্রবণতা। আটঘন্টা কাজ করার মজুরি প্রকৃত আধঘন্টার জন্যই পাচ্ছে কি’না বা 12 ঘন্টার জন্য যা মজুরি দিচ্ছে তাই আট ঘন্টার মজুরি কি’না কে যাচাই করবে।
একজন সিকিউরিটি গার্ডের বেতন আপনারা জানেন। মাত্র 5 হাজার থেকে 10 হাজার টাকা। এর জন্য সেই ব্যক্তি কে 12 ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হয়।
বিচ্ছিন্ন শ্রমিক শ্রেণী ও শ্রমিক স্বার্থ-
পৃথিবীতে যত রকম শ্রমিক আছে তারা সঙ্ঘবদ্ধ নায়। অবশ্য এ একটি হাস্যকর ধারণা- পৃথিবীর শ্রমিকদের সংঘবদ্ধতা। ভারতের শ্রমিক তো দূর, পশ্চিমবঙ্গের সকল শ্রমিক কি সঙ্ঘবদ্ধ? তাদের কি ইউনিটি আছে? একদিকে বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিক, সরকারি, বেসরকারি সংস্থা, অন্যদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মদদপুষ্ট শ্রমিক সংগঠন। শ্রমিকদের কি স্বার্থ সংরক্ষিত হয় বলা মুশকিল। তবে রাজনৈতিক দলগুলো সমস্ত শ্রমিকদের মধ্যে নিজেদের রং দিয়ে সাজায় এবং রঙের আশ্রয়ে থাকার জন্য বিভাজন নীতি প্রয়োগ করে, একটি একক বৃহৎ সংগঠন তৈরি পথে বাধা সৃষ্টি করে তা পরিষ্কার। লাল বলে সবুজ খারাপ, সবুজ বলে গৈরিক বিভাজন নীতি প্রয়োগ করে। সাদা বলে আমরাই শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষন করে থাকি।
আসলে শ্রমিকরা তাদের স্বার্থ দেখার সময় এবং সাহস কোনটাই করে না। কাজ যাবার ভয়ে। কাজ চলে গেলে পরিবার অনাহারে মরবে। অন্যদিকে স্যাক হয়ে গেলে হাজির হবেন দাদা দিদিরা। শুরু হবে প্রতিশ্রুতি দেবার খেলা। দুর্বলতা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক খেলা। এখান থেকে একটা প্রশ্ন আসে শ্রমিকরা কি রাজনৈতিকভাবে সচেতন? আপনারা কি বলেন। মতামতের অপেক্ষায় রইলাম। কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানান।
শ্রমিক হয়েও নিজেকে শ্রমিক না ভাবা-
ভিন্ন একটি কারনের কথা বলা যেতে পারে- বিভিন্ন সেক্টরে শ্রমিকরা আবার নিজেদের শ্রমিক হিসেবে ভাবতে চান না। যেমন- চাকুরীজীবী ব্যক্তিবর্গ, অফিসার হলে তো কথাই নেই। তারা নিজেদের শ্রমিক বলতে একটু কুণ্ঠাবোধ করেন।অপমানিত বোধ করেন। নিজেদের সার্ভিস হোল্ডার, এমপ্লয়ি, অফিসার হিসেবে বিচার করতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। লেবার বা ওয়ার্কার বলতে নারাজ। লেবার বা শ্রমিক বলতে অনেকের ধারণা- মাঠে-ঘাটে রাস্তায় বনে-জঙ্গলে যে সমস্ত ব্যক্তিরা কাজ করে থাকেন তাদের কে বোঝায়।
আর এখানেই এসে পড়ে বিভাজনের বামনত্ব-কুলিনত্ব খেলা। শ্রমিক শব্দটি যেন অপুষ্টিতে ভুগছে, অপমানজনক। এ বিভাজনের নীতিটি হয়ে ওঠে মালিকপক্ষের কাছে এক শক্তিশালী ধারালো অস্ত্র। যে অস্ত্র দেখিয়ে বাজিমাত করে তারা। ভাই, যে শ্রম করে সেই শ্রমিক। তে ওয়ার্ক করে সেই ওয়ার্কার। যে লেবার দেয় সেই লেবারার।
বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যাবলী ও ক্ষেত্র-
তবে ওয়ার্কারদের বিভিন্ন ধরন রয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। বিভিন্ন সেক্টর রয়েছে এবং কাজকর্মের পদ্ধতি রয়েছে। কাজ করার ধরন এবং শ্রেণী অনুযায়ী সারা পৃথিবীর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোকে মোটামুটি পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়। এবং এই পাঁচ ক্ষেত্রের শ্রমিকদেরও পাঁচটি বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। পাঁচটি ক্ষেত্রের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিচে দেওয়া হল-
প্রাথমিক অর্থনৈতিক কার্যাবলি-
প্রথম ক্ষেত্রটি প্রাথমিক অর্থনৈতিক কার্যাবলি হিসাবে চিহ্নিত। সভ্যতার মানুষ অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হয় তখন এই কাজটি মানুষ তার কর্মজীবন শুরু করে। যেমন বনজদ্রব্য সংগ্রহ, কৃষিকাজ, পশুপালন ইত্যাদি ইত্যাদি। বর্তমানে এই কাজ এখনও পর্যন্ত রয়েছে। এবং এই কাজের সময় যে সমস্ত কর্মীরা নিযুক্ত রয়েছেন তাদের রেড কলার ওয়ার্কার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
দ্বিতীয় ধরনের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ-
গৌন অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে ইংরাজীতে সেকেন্ডারি একোনোমিক অ্যাক্টিভিটিও বলা হয়। সাধারণত উৎপাদন মূলক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ধরনের কাজকে এই সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কলকারখানায় বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক অথবা কোন ফার্মে কোন দ্রব্য উৎপাদন পদ্ধতি কাজের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই ধরনের শ্রমিকদের Blue কলার ওয়ার্কার বলা হয়ে থাকে.
তৃতীয় ধরনের অর্থনৈতিক কার্যাবলি-
প্রগৌন অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে ইংরাজীতে একে টার্সিয়ারি ইকোনোমিক একটিভিটি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এই অর্থনৈতিক কার্যাবলি সাধারণত ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগব্যবস্থা, বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট সেবা মূলক এবং পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত কাজকর্ম এই শ্রেণীর অন্তর্গত। এই শ্রেনীর কর্মীদের পিংক কালার ওয়ার্কার বলা হয়ে থাকে।
চতুর্থ ধরনের অর্থনৈতিক কার্যাবলি-
চতুর্থ ধরণের অর্থনৈতিক কার্যাবলীকে কোয়াটারনারি ইকনোমিক অ্যাক্টিভিটি বলা হয়। বিশেষত সেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের এর আওতায় আনা হয়। শুধু সেবামূলক নয়, বিভিন্ন সংস্থায় পরিচালকের কাজে যুক্ত কর্মীরা এর অন্তর্ভুক্ত। শিক্ষকতা, স্বাস্থ্য সেবায় নিযুক্ত কর্মীরা, ফিনান্সিয়াল ডিপার্টমেন্ট ব্যক্তিরা, এক্সিকিউটিভ অফিসার ইত্যাদি ইত্যাদি কর্মীরা এই শ্রেণীর অন্তর্গত। এই সেক্টরের কর্মীদের হোয়াইট কলার ওয়ার্কার বলা হয়। হোয়াইট কলার ওয়ার্কাররা নিজ নিজ পেশায় যথেষ্ট দক্ষ হিসাবে বিবেচিত।
পঞ্চম স্তরের অর্থনৈতিক কার্যাবলী-
সর্বশেষ অর্থনৈতিক কার্যাবলী হল কুইনারি ইকোনমিক অ্যাক্টিভিটি। এই শ্রেনীর ওয়ার্কারের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুবই কম অর্থাৎ উপরে উল্লেখিত যতরকম কাজের ক্ষেত্র গুলি বলা হলো এর পেছনে কুইনারি এক্টিভিস্টদের কার্যক্রম এর ফলাফল দেখতে পাওয়া যায়। এরা অত্যধিক পরিমাণে বুদ্ধিমান এবং স্কিলড, প্রফেশনাল হিসেবে বিবেচিত। বিজ্ঞানী, রিসার্চ স্কলার, ইনোভেটাররা এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তৌ। এই শ্রেনীর কর্মীদের গোল্ডেন কালার ওয়ার্কার বলা হয়ে থাকে। এদের বুদ্ধাংক এর মাত্রা, চিন্তাভাবনার মাত্রা এত উচ্চমানের যে এদের think tank হিসেবে অভিহিত করা হয়।
শ্রমিকশ্রেণিগুলি পরস্পরের প্রতি অশ্রদ্ধা-
এখন উপরে উল্লেখিত পঞ্চম ক্ষেত্রটি বাদ দিলে বাকি যে চারটি ক্ষেত্র পাওয়া যায় এই চারটি ক্ষেত্রের কর্মীদের একে অপরের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিমাণ নেহাতই নগণ্য। একে অপরের প্রতি বিশ্বাস এবং একে অপরের সমস্যায় বা বিপদে পাশাপাশি দাঁড়ানো দেখাই যায় না। অথচ কোন একটি অংশ কাজে দিলে পুরো ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়বে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলি একে অপরের সঙ্গে যুক্ত-
এখানে চিন্তা করা একান্তই দরকার- প্রত্যেকেই কিন্তু লেবার বা ওয়ার্কার- এই ভাবনাটা থাকা অত্যন্ত জরুরী। তবে এর মধ্যে কোন কোন ব্যক্তি আবার আত্মনির্ভরশীল বা self-employed হিসেবে কাজ করে থাকতে পারেন। তিনি হয়ত নিজেই তার মালিক, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন। কেননা তার পরিষেবা অথবা উৎপাদিত দ্রব্যাদি তৈরি করা এবং বিক্রি করার জন্য কারো না কারোর উপর নির্ভর করে থাকতে হয়।
অন্যান্যদের ক্ষেত্রে রয়েছে একদিকে মালিকপক্ষ বা তার কাছাকাছি লোকজন। অর্থাৎ এক্সিকিউটিভ বা অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বা ম্যানেজমেন্টের লোকজন। আর অন্যদিকে রয়েছেন অন্যান্য কর্মীরা। এক্সিকিউটিভ কর্মীরা যারা ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থেকে বিভাজনের নীতি জিইয়ে রাখার কঠোর প্রয়াস চালিয়ে যায়। কিন্তু নিচু তলার কর্মীদের গুরুত্ব রয়েছে। তারা কাজ না করলে যে সমগ্র ইন্ডাস্ট্রি ভেঙে পড়তে পারে এটা ভাবা দরকার।
Poster for Labourday | Labourday Poster-
তাই এ সময়ের শ্রেণি বিভাজন ভুলে সমস্ত শ্রমিক শ্রেণী এক ছাতার তলায় না দাঁড়ালে সমূহ বিপদ। অন্যদিকে মালিক পক্ষ শ্রমিক স্বার্থ না দেখলে বা গুরুত্ব না দিলে হঠাৎ সম্পূর্ণ সিস্টেমটাই ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যেতে স্ময় নেবে না।
আবার সেই শুরুর কথাতেই এসে পড়লাম আদতে শ্রমিক স্বার্থের গুরুত্ব কতখানি রয়েছে? বর্তমানে মে দিবসের বিভিন্ন কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন এর অফিস গুলিতে অথবা ক্লাবে পতাকা উত্তোলন হবে। সরকারি-বেসরকারি বিভাগে সেদিন ছুটিও থাকে, কিন্তু শ্রমিকদের স্বার্থ কি প্রকৃত সংরক্ষিত আছে? নাকি আবারও পৃথিবীব্যাপী শ্রমিকস্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আবার নতুন করে কোন একটা শ্রমিক আন্দোলন প্রয়োজন হবে? বা প্রয়োজন আছে? অবশ্যই কমেন্ট করে জানান। ভাল থাকুন। সঙ্গে থাকুন। নিজেকে শ্রমিক হিসেবে ভাবুন- তাতে যত বড়ই হোক না কেন।
একে অপরের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে পুনরায় শ্রমিকস্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এক ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে পুনরায় আন্দোলনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক আন্দোলন তা কেবলই শ্রমিকদের। ধন্যবাদ।