ধ্বংস হচ্ছে শিক্ষা- পাশ ফেল প্রথা তর্ক বিতর্ক | Pass Fail Debate

পাশ ফেল প্রথা তর্ক বিতর্ক এবং পাশ ফেল থাকুক বা না থাকুক কী এসে যায় তাতে। বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যত না মানুষ হয়ে ওঠার উদ্দেশ্য সাধন করে তার তুলনায় কর্মে নিযুক্ত হবার বা চাকরিতে যোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে বেশি করে প্রাধান্য দেয়। মুখে আমরা যতই বলি না প্রকৃত শিক্ষার সাতকাহন। প্রকৃত শিক্ষার মূলসূত্র বেশিরভাগটাই জড়িয়ে আছে অর্থনীতির সাথে। আবার না থেকে উপায় নেই। বর্তমান ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর বাজার অর্থনীতি এবং ব্যাপক অর্থে বলতে হয় সাম্রাজ্যবাদী নীতি তথা ব্যবস্থাপনা শিক্ষাকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে রেখেছে। সাধারণ মানুষ সেজন্যই প্রকৃত শিক্ষাকে যত না বিশ্বাস করে তার তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উপর আস্থা ঢের বেশি।

আমি হলফ করে বলতে পারি অভিবাবকরা যখন ছাত্রছাত্রীকে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করে তখনই তাদের মনের কোণায় প্রজ্বলিত হয়- ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবনের সম্ভাবনার টানাপোড়েন। বলা যায় তখন থেকে সূচিত হয় এক স্বপ্ন তাদের ছেলে মেয়ের স্বাবলম্বী হবে অর্থনৈতিকভাবে, তবেই স্বাধীন হতে পারবে বস্তুগতভাবে। ক্রমে ক্রমে মানসিকভাবে চাহিদা পূরণের সাথে সাথে পরিতৃপ্তির আত্মসুখে সমৃদ্ধ হবে তারা। এই বাসনা সকল অভিভাবকদের ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে প্রায় একই। এভাবেই এককের সমৃদ্ধির সাথে জড়িয়ে থাকে রাষ্ট্রীয় জাতীয় স্বার্থ। আশা করি সকলেই এ কথা স্বীকার করবেন।

পাশ ফেল প্রথা তর্ক বিতর্ক

পাশ ফেল প্রথা তর্ক বিতর্ক কোথায়?

উদ্দেশ্য যদি তাই হয় তবে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তন সাধন প্রয়োজন। তবে কেবলমাত্র শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তনের বিষয়টা পরিসমাপ্তির পথে যাবে তাও নয়। প্রয়োজন বিভিন্ন চাকরির প্রতিষ্ঠান নিয়োগ পদ্ধতি প্রয়োজন। কি সরকারি ক্ষেত্রে, কি বেসরকারি ক্ষেত্রে সকল ক্ষেত্রে নিয়োগ পদ্ধতি পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়। নতুবা আমি যে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলতে যাচ্ছি তার কিন্তু বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

বর্তমানে বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্রছাত্রীরা কর্মের নিয়োগের শিক্ষা যদি অন্যতম হয় তাহলে আরেক অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো- বেশি সংখ্যক প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করা। অন্যদিকে স্কুল ছুট বন্ধ করা। প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আনয়ন, তাদের বিদ্যালয় ধরে রাখা, স্কুল ছুট বন্ধ করার মত উদ্দেশ্যগুলি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মধ্যাহ্ন আহার প্রকল্প, বিনামূল্যে পোশাক পুস্তক বিতরণ, শারীরিক মানসিক নির্যাতন বন্ধের(কর্পোরাল পানিশমেন্ট/Corporal Punishment) সাথে সাথে পাশ ফেল(Pass Fail) প্রথা তুলে দেওয়া হয়েছে। একদিকে প্রকল্পগুলো চালু হওয়াতে যেমন সরকারি কোষাগারে চাপ বেড়েছে, তাই বরাদ্দ বেড়েছে। অন্যদিকে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বলা যেতে পারে উদ্দেশ্য সাধু।

প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আনয়ন, তাদের ধরে রাখা, তথা স্কুল ছুট বন্ধ করার জন্য পাশ ফেল(Pass Fail) প্রথার বিলোপ সাধনের নিমিত্তে পরীক্ষা নামক দানবদের চেহারা পরিবর্তন করে সার্বিক নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন(Continuous Comprehensive Evaluation/CCE) ব্যবস্থার প্রচলন ও গ্রেডেশন ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়েছে।

পদ্ধতিগুলির থেকে আসুক সুফলের আশা না করেও বলা যেতে পারে এবার এদের মূল্যায়ন করার প্রয়োজন এসেছে। ঠিক এখান থেকেই শুরু পাশ ফেল প্রথা তর্ক বিতর্ক।

প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় আনন্দ, তাদের ধরে রাখার উদ্দেশ্যে এর অন্যতম প্রচেষ্টা হলো পাশ ফেল(Pass Fail) প্রথা বন্ধ করা। মধ্যাহ্ন আহার, বিনামূল্যে পোশাক বিতরণ, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন বন্ধের মতো নীতিগুলি প্রচলন করা অন্যতম সহযোগী প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য হয়। সহযোগী বলার কারণ হলো আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য কিন্তু শিক্ষা প্রদান। শিক্ষার্থীকে শিখতে হবে আর শিক্ষকদের শেখাতে হবে। আর এটাই হল প্রধান উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য অন্যান্য নীতিগুলি প্রচলন আবশ্যক অর্থাৎ অন্যান্য নীতিগুলি সহযোগী হিসেবে শিক্ষা নামক আচরণ পরিবর্তনকারী রূপটি বাস্তবায়িত করে।

এখন হয়েছে কি প্রধান উদ্দেশ্য অর্থাৎ শিক্ষাকে বাস্তবায়িত করার জন্য যে সহযোগী তন্ত্র বিদ্যমান সেগুলিকে পরিচর্যায় উপরমহল থেকে একেবারে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত এত ব্যস্ত যে, প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় আসছে, কোন কোন দিন সারাদিন থাকছে, কোনদিন অর্ধদিবস। এভাবে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বছরে কাজের দিনের100 শতাংশ থেকে 10 শতাংশ উপস্থিতি বা কমবেশি 30%।

মধ্যবিত্ত বাড়ির শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে অর্ধদিবস বাড়ি পালানোটা উৎসব। কেন না, না গেলে টিউশন কামাই হবে। টিউশনেমাসে টাকা লাগে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা শিক্ষক মহাশয় কিন্তু বিদ্যালয় না থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করতে পারবেন না। কেননা কোনটা মানসিক নির্যাতন আর কোনটা নয় শিক্ষকদের কাছে সেটাও পরিষ্কার নয়। ভালবেসে বললেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জবাব আসে স্যার আপনাদের হাত-পা বাঁধা। আপনারা এখন ঢোঁড়া সাপ। আর কড়াভাবে বললে হয়তো আর আসবে না। অথবা উত্তর আসে স্যার মারা তো দূরের কথা আপনারা এখন বকতেও পারবেন না।এগুলোই কিন্তু বর্তমান ঘটনা। এর বিপরীতে খুব কম ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত রয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত সার্বিক ফল প্রকাশ বা সার্বিক উদাহরণ ধরা যাবে না।

কোনদিন বিদ্যালয়ে উপস্থিতির সংখ্যা বেশি?

বছরে একদিন কিন্তু শ্রেণীতে উপস্থিতির সংখ্যা 98 থেকে 100%। সেদিনটা হলো পোশাক বা স্কলারশিপের জন্য টাকা বিতরণের দিন। এখন তো আবার চেকের মাধ্যমে বা ECS এর মাধ্যমে স্কলার্শিপ এর টাকা আসছে। তাই বিদ্যালয়ে ওই দিনটাতেও ভীড় নেই। এ কথাগুলো বলতে চাইছি না কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি। প্রথম প্রজন্ম কেন, নিম্ন মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীরা যদি আগে থেকেই পরীক্ষার ফলাফল জেনে যায়, তারা নিজের চাহিদার প্রয়োজন যদি না বোঝে, শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা যদি না অনুভব করে তাহলে সারা বছর কেনই বা পড়াশোনা করবে? আর বিদ্যালয়ই বা কেন আসবে বা বিদ্যালয়ে থাকবে। তারা তো বছরের শেষে উত্তীর্ণ প্রগতি পত্র পেয়ে যাচ্ছে।

এভাবে যে উচ্চপ্রাথমিক মাধ্যমিকে পাশ করল সেই শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হল অর্থাৎ ছোট নদী থেকে বড় নদীর উথাল পাথাল সময়। তার আগে তিন মাস পড়াশোনা থেকে অনেক দূরে। বিষয় পছন্দ, পাঠ্যসূচি বুঝতে বুঝতে আরো 3-4 মাস। একাদশ পরীক্ষার সম্মুখীন। এরপর এর মাঝে অনেক স্কুলছুট, অনেকে আবার বাবাকে কাজে সহায়তা করা, অনেকে আবার ভোকেশনাল বা আইটিআই বা অন্য কিছু।

আমাদের উদ্দেশ্য কিন্তু উচ্চ প্রাথমিক পর্যন্ত পাশ ফেল(Pass Fail) তুলে দেওয়া। তারপর থেকে নয়। অর্থাৎ মাধ্যমিকটা ভালো ভাবে পাশ করতে হবে। এখানেও কিন্তু পাশ মার্ক নেমে এসেছে 34 থেকে 25 এ। এবং 25 এর যারা পাচ্ছে তাদেরকে অনেক সময় গ্রেস দিয়ে পাস করানো হয়। তাহলে বলতে পারি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে মাধ্যমিক পাশের সংখ্যা কিন্তু বেশ নগণ্য।

কম নম্বর পাওয়া কী করবে?

মাধ্যমিক পাশের পরিসংখ্যানগত হিসাব দেওয়া যেতে পারে। এভাবে পাশ করা প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পাস 100% ধরে নিলাম। এর মধ্যে কিন্তু প্রকৃত পাস করবে কুড়ি থেকে ত্রিশ শতাংশ। এরা গ্রেস না দিয়ে সমস্ত বিষয়ে পাশ। প্রথম থেকে অষ্টম পর্যন্ত সমস্ত বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হলেও অর্থাৎ ডি পেলেও প্রমোটেড আন্ডার কনসিডারেশন লেখা হয়। এবার 70 থেকে 80 পার্সেন্ট মাধ্যমিকে বসলে তার 80% অর্থাৎ 56 থেকে 64% মাধ্যমিক পাশ করে। এর মধ্যে আবার গ্রেস পাওয়া শিক্ষার্থীও থাকে 10 শতাংশ। অর্থাৎ যাদের পাস নাম্বার 25 করে দেওয়া হয়। 56 থেকে 64 শতাংশ থেকে 10 শতাংশ বাদ যাবে অর্থাৎ 46 থেকে 54 শতাংশ প্রকৃত মাধ্যমিক পাশ পরীক্ষার্থী।

প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল 100 জন মাধ্যমিকে পাস করলো মাত্র 46 থেকে 54%। অর্থাৎ বাকি 54 থেকে 46 জন পরীক্ষার্থী কোথায় গেল? এরা কি কোন চাকরিতে যোগদান করতে পারবে, না তারা সেই যোগ্যতা মানে পৌঁছাতে পেরেছিল?

লোকসান-

অনেক দিক দিয়েই কিন্তু লোকসান হলো। শিক্ষার কাজে নিযুক্ত সকল কর্মীর প্রতিষ্ঠানে অনেক সময় নষ্ট হলো, সরকারি অর্থ নষ্ট হলো। ওই সমস্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে একমাত্র কৃষি মিস্ত্রি মজুর ছাড়া অন্যান্য উৎপাদন মূলক কাজে অংশগ্রহণ আশা করা যায় না। কৃষি ক্ষেত্রে শ্রমিক মজুরই যদি হবে তাহলে বছরের পর বছর কেবলমাত্র নাম সই আর ছোটখাটো যোগ বিয়োগ শেখার জন্য অনেকগুলো বছরই বিদ্যালয়ে যাওয়া কেন? এর জন্য মাত্র একটা বছর ব্যয় করা যথেষ্ট নয় কি? আট বছর কেন?

এবার এখানে পাশ ফেল প্রথা তর্ক বিতর্ক শেষ হওয়া প্রয়োজন। ছাত্রছাত্রীদের মন খুবই সরল। তার বোঝে না পাশ ফেলের প্রকৃত গুরুত্ব। তারা কেবল বোঝে পাশ মার্কশীট। সে কী শিখলো, কী সিকলো না, সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখে না। তারা আগাম পাশের ফলাফল পেয়ে যাচ্ছে। পুরস্কৃত হয়ে যাচ্ছে অনেক আগেই। সেখানে তারা না শিখে, না পরিশ্রম করেই লাভবান হবার চেষ্টা করবে। তবে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে এই ভাবে মূল্যায়ন করায় ঠিক নয়। সচেতন শিক্ষার্থী, সচেতন অভিভাবকদের বিষয়টি ভিন্ন। সে সংখ্যা সর্বাধিক 30 শতাংশ হতে পারে।

প্রকৃত শিক্ষা ক্ষেত্র-

শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা যেমন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত, সেরকম প্রকৃত শিক্ষা ও তার ক্ষেত্রগুলিকে অবহেলা করা মূর্খামী। আমরা বিভিন্ন শিক্ষাবিদদের সংজ্ঞা ও বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। কেননা পাশ্চাত্য-প্রাচ্য শিক্ষা প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদদের তুলনা, মিল অমিল নিয়ে একটি লেখায় সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।

তবে প্রকৃত শিক্ষা ক্ষেত্রের মূল বিষয়গুলি সংক্ষিপ্তাকারে এভাবে বলা যেতে পারে- সামাজিক সম্পর্ক ও সমজিকতার আদান-প্রদান, মেলবন্ধন, সম্পর্ক স্থাপন ও তা বহন করার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সংস্কৃতির আদান-প্রদান, সভ্যতার বিবর্তিত রূপ গুলি সম্পর্কে সচেতন হওয়া, পরিবেশ রক্ষার শুভশ্রীগুলির অনুভব ও অনুকরণ করে তার বাস্তবায়ন ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরী। মূল্যবোধের গুরুত্ব অনুধাবন ও তা সচল রাখার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সমস্ত যা কিছুই বলে হোক না কেন বিদ্যালয়ে 5 ঘণ্টা সময় তা কেবলমাত্র পাঠ্যসূচি সমাপ্ত করাটাই মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

তথাপি পূর্বনির্ধারিত পাশের ফলাফল হাতে নিশ্চিত পাবে বলেই পাঠের প্রতি অবহেলা। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে, পাঠে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আনার জন্য পাশ ফেল ফিরে আসুক ও পাশ ফেল প্রথা তর্ক বিতর্ক অবসান হোক।

আরো পড়ুন- প্রাসঙ্গিক শিক্ষা

Leave a Comment