শ্রীলঙ্কার সংকট (Sri Lanka crisis) শুধু কি শ্রীলঙ্কার জনজীবনকে অন্ধকারে নামিয়ে এনেছে? না’কি ভারতের মধ্যে এর প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে? সাধারণ মানুষ হিসেবে শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকট(Sri Lankan Economic Crisis) পরিস্থিতি দেখে এই আশঙ্কা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দুর্দশা কোন সীমায় পৌঁছাতে পারে শ্রীলংকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আসুন দেখে নেওয়া যাক শ্রীলংকা সংকটের পেছনে কারণ গুলি কি কি? সত্যিই কারণগুলো ভারতের মতো দেশে কোনো অন্ধকার গলিতে দাঁড়িয়ে চুপিসারে হাসছে কি’না তারও সন্ধান নেওয়া বিশেষ জরুরী।
শ্রীলঙ্কার সংকট পরিণতি শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবসাইট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দ্বীপ জুড়ে কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে। দেশে জ্বালানি ও খাদ্যের ঘাটতি রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। মানুষ ক্ষুব্ধ। এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কা দানবাকৃতি সাংঘাতিক ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের(Sri Lanka crisis) মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর পেছনের কারণগুলো কী?
অতি সাধারণ মানুষের মধ্যে অতি সরলীকরণ এর মাধ্যমে আমরা বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করব। খাদ্যাভাবের পাশাপাশি পেট্রোল ও ডিজেলের ঘাটতিতেও জনগণকে ভুগতে হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় বিক্ষুব্ধ জনতা রাষ্ট্রপতির বাসভবনে জমায়েতে বিক্ষোভ এবং আক্রমণ করার চেষ্টা করেছে। পুলিশ যারপরনাই চেষ্টা চালিয়েছে বিক্ষোভকে দমন করার। সেখানে জল কামান এবং টিয়ার গ্যাস চালিয়ে জনতার আক্রমণকে প্রশমিত করার সাংঘাতিক প্রয়াস চালানো হচ্ছে। তারা অতি সাধারন জনগন যারা আসলে এমন কিছু করতেও পারে না, অথচ তারা শুধু দেশ ছেড়ে চলে যাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার এই মুহূর্তের অবস্থাটা বোঝা অত্যন্ত জরুরী। তা না হলে আমরা পরবর্তী পর্যায়ের অবস্থাটা বুঝতে পারবো না। ২০২২ ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ২.৩ বিলিয়ন ডলার। জানুয়ারী ২০২০-এর তুলনায় এটি 70% এর নিচে নেমে গেছে। একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সংরক্ষণের পরিমাণ কম থাকলে তার পক্ষে পণ্য আমদানি করা কঠিন। বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যা অবস্থা তাতে এই দেশ মাত্র এক মাসের প্রয়োজন মেটানোর মতো পণ্য আমদানি করতে পারবে। তাছাড়া এই দেশটিকে ৪ মিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধও করতে হবে।
Importation of Sri Lanka versus India-
ভারতে আমদানি করা পণ্য বলতে বিলাসবহুল দ্রব্যকে বিশেষভাবে বোঝানো হয়। যেমন- ফোন, আমদানি করা ল্যাপটপ, আমদানি করা গাড়ি ইত্যাদি। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি এমন যে, সেখানে মৌলিক অতি প্রয়োজনীয় পণ্যগুলিও আমদানি করতে হয়। অর্থাৎ আমদানী পণ্যের উপর শ্রিলংকাবাসীকে বিপুল্ভাবে নির্ভর করতে হয়। যেমন- চিনি, ডাল জাতীয় শস্য, ভোজ্যতেল,ঔষধপ্ত্র ইত্যাদি। ভারতে অবশ্য এই মৌলিক পণ্যগুলি উত্পাদিত হয়। তবে রাজ্য বিশেষে এগুলো বিভিন্ন রাজ্য থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। তবে অন্য দেশ থেকে খুব একটা আমদানি করতে হয় না। কিন্তু শ্রীলঙ্কাকে এগুলো অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কম থাকায় এগুলো আমদানি করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
তাই বলা যেতে পারে শ্রীলঙ্কা ও ভারতের স্বনির্ভরতায় যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে(There are some major difference of self-independency between Sri Lanka and India)। তাই বলে এই নয় ভারত সব বিষয়েই স্বনির্ভর। অথবা শ্রীলঙ্কায় অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছে বলে ভারতে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। প্রত্যক্ষ প্রভাব না থাকলেও পরোক্ষে ভারতের অর্থনীতির উপর প্রভাব পড়তে বাধ্য। এ বিষয়ে পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনায় আসছি।
মূল্যবৃদ্ধি ও মূদ্রাস্ফীতি-
দেশে প্রাথমিক চাহিদা সম্পন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি দ্রুত মূল্যস্ফীতির দিকে পরিচালিত করে। তাই শ্রীলঙ্কা দ্রুত উচ্চ মূল্যস্ফীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কায় 25% মূল্যস্ফীতি দেখা গেছে। ফলস্বরূপ মূল্যবৃদ্ধির চক্রে পড়ে জনগণ মৌলিক জিনিস কিনতে অসুবিধা সম্মুখীন হয়। অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অন্যতম চালের দর এক সপ্তাহের মধ্যে 500 শ্রীলঙ্কান কারেন্সী পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।
Rate of Essential Commodities in Sri Lanka-
এই ব্লগটি লেখার সময় ১টাকা= ৪শ্রীলঙ্কান কারেন্সী। আজ, চাল LKR 290/কেজি। চিনি: LKR ২৯০/কেজি। দুধের গুঁড়া: ৪০০ গ্রামের জন্য ৭৯০ শ্রীলঙ্কান টাকা। কিছু রেস্তোরাঁয়, এক কাপ চায়ের দাম এখন ১০০ শ্রীলঙ্কান টাকা৷ একজন শ্রীলঙ্কার চাকুরীজীবি 3 জন সদস্যের পরিবারে মাসিক খরচ ছিল প্রতি মাসে ৩০০০০ শ্রীলঙ্কান কারেন্সি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৮৩০০০ শ্রীলঙ্কান কারেন্সীতে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন দ্রব্যের চাহিদার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে উঠছে ঘাটতির বহর।
বিদ্যুতের সমস্যাও সেখানকার মানুষদের বিপর্যয়ে ফেলেছে। অন্যান্য দেশ থেকে জ্বালানি আমদানির ঘটতি প্রভাব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। মানুষ দিনে মাত্র ৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাট সামান্যতম মেটানোর জন্য শ্রীলঙ্কার বিদ্যুৎমন্ত্রী কর্মকর্তাদের স্ট্রিট লাইট বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সরকার তাদের ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছে, লঙ্কান ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের শ্রীলঙ্কান শাখা থেকে ডিজেল আনতে। LIOC শ্রীলঙ্কাকে ৬০০০ MT ডিজেল দিয়েছে। যাতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বস্তি পায়। সপ্তাহে মাত্র একবার রান্নার গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এবং একটি গ্যাস সিলিন্ডারের দাম, ৩০০০ থেকে ৪২০০ শ্রীলঙ্কান কারেন্সি। এটি ভারতের মূদ্রায় প্রায় ১২০০টাকার মতো। জ্বালানি স্টেশনের বাইরে দীর্ঘ লাইন।
সংবাদপত্র ও মুদ্রণ শিল্পেও এর প্রভাব পড়েছে। সংবাদপত্রকে তাদের ছাপার পরিমান কমাতে হচ্ছে। কারণ বিদ্যুতের ঘাত্তির সাথে সাথে মুদ্রণ সামগ্রীরও ঘাটতি রয়েছে। স্কুলের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এই তীব্র খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কারণ মানুষকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করছে।
Refugee problem of India-
ভারতের রামেশ্বরমের কাছে একটি দ্বীপে ছয় শরণার্থীর প্রথম একটি দলকে দেখা গেছে। জানা গেছে যে তারা জেলেকে ভারতীয় জলসীমার একটি দ্বীপে নামিয়ে দেওয়ার জন্য ৫০০০০ শ্রীলঙ্কান টাকা দিয়েছিল। এই ছয় শরণার্থী হল এক যুবক দম্পতি, তাদের 4 মাস বয়সী শিশু, অন্য একজন মহিলা, তার 2 সন্তান। ভারতীয় উপকূলরক্ষীরা তাদের উদ্ধার করে এবং উপকূলরক্ষী ক্যাম্পে আশ্রয় দিয়ে খাওয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পরে, তাদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়, তারা পরে একটি শরণার্থী শিবিরে নিয়ে যায়। তারপর ১০ শরণার্থীর আরেকটি দলেরও সন্ধান পাওয়া যায়। তারা ৩০০০০০০ শ্রীলংকার টাকা খরচ করেছে, যাতে তারা তাদের দেশ থেকে পালিয়ে নিরাপদে ভারতে পৌঁছাতে পারে।
আপনি দেখতে পাচ্ছেন মানুষ কতটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং মরিয়া হয়ে উঠেছে। তামিলনাড়ুর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের আলোচনা ও মতামত অনুযায আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভারতে ২০০০ শরণার্থী আসতে পারে। এই বিষয়ে আলোচনা করার জন্য, তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্টালিন, প্রধানমন্ত্রী মোদীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তামিলনাড়ু সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন যে শ্রীলঙ্কার তামিলরা যারা শরণার্থী হিসাবে তামিলনাড়ুতে আশ্রয় নেবেন, তাদের রাজ্য সরকার যাতে মানবিক সহায়তা দিতে পারে। এভাবেই ভারতে উদবাস্তু সমস্যার সৃষ্টি ও তা বৃদ্ধি পেতে(Refugee problem of India) পারে শ্রীলঙ্কার এই সংকটময় সমস্যার জন্য(Refugee problem of India may be created and increased other problems)।
Help of India to resolve Sri Lanka crisis-
ভারত শ্রীলঙ্কাকে অন্যান্য উপায়ে সাহায্য করছে। ১৭ই মার্চ, শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রী নয়াদিল্লির সাথে $১ বিলিয়ন ক্রেডিট লাইনে স্বাক্ষর করেন। বছরের শুরুতে, জ্বালানি ক্রয়ের জন্য $৫০০ মিলিয়ন ক্রেডিট লাইন স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ভারত ৪০০ মিলিয়ন ডলারের কারেন্সি হস্তান্তর করেছে। এবং এখন, শ্রীলঙ্কা ভারতের কাছ থেকে আরেকটি ক্রেডিট লাইনের জন্য $১ বিলিয়ন অনুরোধ করছে। যাতে তারা তাদের দেশের জন্য মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি করতে পারে এবং পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। বলে রাখা ভালো ভারত ও শ্রীলঙ্কা পাশাপাশি দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ, তাই তাদের প্রতি ভারতের সহায়তা এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মাত্র(Sri Lanka and India are two friendful neighbouring country, so Help of India to Sri Lanka is a spontaneous process) ।
Help of other countries-
ভারত ছাড়াও বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রীলংকা সাহায্য চাইছে। তারা সাহায্যের জন্য চীনের কাছে অনুরোধ করেছে। শ্রীলঙ্কা চীনের ঋণের সীমা পরিসীমা নেই, এক কত গভীরে ডুবে আছে। চীনের অনেক ঋণ পরিশোধ করতে করতে করতে শ্রীলংকার নাজেহাল অবস্থার হয়েছে। ঋণ পুনর্গঠন ও পুনর্নবীকরণ করতে চীনকে অনুরোধ করেছে শ্রীলঙ্কা। এর সাথে, তারা চীন থেকে $2.5 বিলিয়ন ক্রেডিট লাইন নিয়ে আলোচনা করছে। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের সাথেও আলোচনা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি আগামী মাসে ওয়াশিংটন ডিসিতে যাবেন। উদ্দেশ্য যাতে তারা শ্রীলংকার নাগরিকদের জন্য উপযুক্ত অন্তত একটি সাধারণ সংকটমোচন পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে। দেশকে দেশের নাগরিকদের বাঁচানোই এখন প্রধান উদ্দেশ্য।
Reasons of Sri Lankan Economic Crisis-
সকলেই খবর শুনছেন, ছবি ও ভিডিও ক্লিপিং দেখছেন। শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকটাপন্ন(Sri Lankan Economic Crisis) মুহূর্তের ছবিগুলি আপনার চোখের সামনে ভাসছে। কিন্তু প্রকৃত কারণ গুলো জানার চেষ্টা করেছেন কি? এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল কেন এমন হল? কি কারণে শ্রীলঙ্কার এই অবস্থা। আসুন জেনে নেওয়া যাক।
এই দুর্বিসহ এবং যন্ত্রণাময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির একাধিক কারণ(There are several Reasons of Sri Lankan Economic Crisis) রয়েছে। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারণ নিয়ে পর্যালোচনা করা খেতে পারে-
পর্যটন শিল্পে আঘাত-
২০১৮ সালে, শ্রীলঙ্কা পর্যটনের জন্য বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় স্থানগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম একটি দেশ ছিল। হাজার হাজার বিদেশী পর্যটক এদেশে বেড়াতে এসেছেন। বিশেষভাবে বলতে গেলে, 2018 শ্রীলঙ্কার জন্য একটি রেকর্ড-ব্রেকিং বছর। ২.৩ মিলিয়ন বিদেশী পর্যটক শ্রীলঙ্কা পরিদর্শন করেছেন। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির প্রায় 12% থেকে 13%, পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। এরপর ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে দেশে একাধিক বোমা হামলা হয়, ইস্টার ডে বম্বিং নামে অবিহিত। তিনটি গির্জা এবং তিনটি হোটেল, বেশ কয়েকটি শহর এই বিস্ফোরণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। বোমা হামলায় ২৬৯ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে ৪৫ জন বিদেশী নাগরিক ছিল। এর থেকে কল্পনা করা যেতে পারে কেন পর্যটন শিল্পের উপর প্রত্যক্ষ আঘাত। সর্বমোট আটটি আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়েছিল।
এই আত্মঘাতী বোমা হামলায় শ্রীলঙ্কার একটু বিশেষ শ্রেণীর নাগরিক স্থানীয় ইসলামিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। এ কারণে পরের মাসে শ্রীলঙ্কায় ব্যাপক হারে মুসলিমবিরোধী সহিংস আক্রমণ শুরু হয়। মুসলমানদের বাড়ি, দোকান, গাড়িতে হামলা, ভাংচুর করা হয়। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে, নেগোম্বো শহরে ১০০-এর বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। কারফিউ জারি করা হয়েছিল। সরকার গুজব বন্ধ করতে ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপ ব্লক করেছিল। কিন্তু এরপরেও শুধুমাত্র ধর্মীয় উত্তেজনা ও ভাবাবেগকে বৃদ্ধি করেছে। 2018 সালেও ক্যান্ডি এবং আমপাড়ায় মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা হয়।
সরকার সেই মুহূর্তে জরুরি অবস্থা জারি ও ফেসবুক ব্লক করতে বাধ্য হয়েছিল। এই ঘটনায় সিংহলী বৌদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলিও হামলার জন্য দায়ী ছিল। পরে যখন ফেসবুকের রহস্য ফাঁস হয়, তখন জানা যায় যে এই দাঙ্গায় ফেসবুকের বিরাট ভূমিকা ছিল। ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলি ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক প্রচারকে উৎসাহিত করেছে। মানুষের মধ্যে ঘৃণা তৈরি করে এবং শেষ পর্যন্ত এই দাঙ্গা শুরু হচ্ছে। ফেসবুক পরে শ্রীলঙ্কায় এই দাঙ্গার জন্য ক্ষমা চেয়েছিল। এসবই পর্যটন শিল্পে ভয়াবহ প্রতিকুল প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু, এটা ছিল সূচনা মাত্র।
কোভিড- ১৯-
2020 সালের মার্চ মাসে, কোভিড -১৯ মহামারী সার বিশ্বে আঘাত হানে। সারা বিশ্বে পর্যটন বন্ধ। দেশের অর্থনীতির 12%-13% পর্যটনের উপর নির্ভরশীল ছিল। পুরো পর্যটন সেক্টর ধসে পড়ে। কিন্তু পর্যটনের একটি পতন কি কেবলমাত্র এতটা ক্ষতি করতে সক্ষম হয়?
ভ্যাট ছাড় ও লকডাউন-
সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত শ্রীলঙ্কাবাসীকে নিক্ষেপ করে অতল অন্ধকারে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে জয়ী হন রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষী। তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারে তিনি দেশের অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার একটি প্রতিশ্রুতি ছিল মূল্য সংযোজন কর অর্থাৎ ভ্যাট অর্ধেকে নামিয়ে আনা। এর আগে ১৫% হারে ভ্যাট নেওয়া হতো। ট্যাক্স কমানোর সহজ ও সরলীকরণের কারণ ছিল মানুষ কম ট্যাক্স দিলে তারা বেশি খরচ করবে। এছাড়াও অন্যান্য অনেক ধ্রণের ট্যাক্স পুরোপুরি ০ শুন্য করে দেওয়া হয়েছে। ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে। যুক্তিতে ভুল কিছু নেই। এটি অনেক ক্ষেত্রে অনেক দেশে সফলভাবে কাজ করেছে। তবে সঠিক সময়ে তা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। তার জন্য চায় সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ।
কিন্তু শ্রীলঙ্কায় এর পরিস্থিতি উল্টোভাবে কাজ করে। এই ট্যাক্স রেট হ্রাসের কার্যকারিতা 1লা ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে শুরু হয়েছে। ৩মাস পরে, কোভিড-১৯ মহামারী আঘাত হানে। যুক্তি ছিল যে ট্যাক্স কমানো হলে লোকেরা আরও বেশি ব্যবহার করবে, কিন্তু লকডাউনের সাথে সাথে মানুষজন দ্রব্যাদি কিনতে, রেস্টুরেণ্টে খেতে, হোটেলে থাকতে বাইরে যেতে না পারায় ভোগের কোনও বৃদ্ধি হয়নি। সুতরাং খরচ বাড়েনি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও হয়নি। আর সরকারকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে।
পাবলিক ঋণ-
শ্রীলঙ্কার পাবলিক ঋণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। 2019 সালে, ঋণ ছিল জিডিপির 94%। ২০২১ সাল নাগাদ, এটি জিডিপির ১১৯%-এ পৌঁছেছিল। কিন্তু কোনোরূপ পরিশোধের ঘটনাও ঘটেনি।
রাতারাতি জৈব কৃষি প্রচলন-
দেশের রাষ্ট্রপতি হঠাৎ স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি “মাস্টারস্ট্রোক” নিয়ে এসেছিলেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনে, তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি দেশের কৃষিকে জৈব কৃষিতে রূপান্তর করবেন। তার প্রচারাভিযানে, তিনি কীভাবে 10 বছরের মধ্যে, কৃষিকে ১০০% জৈব- কৃষিতে স্থানান্তরিত করবেন সে সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন। আর তারপরই হঠাৎ সিদ্ধান্ত। হঠাত রাতারাতি দেশব্যাপী কৃত্রিম সার ও কীটনাশকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।
সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ-
- তিনি চেয়েছিলেন যে দেশটি রাতারাতি ১০০% জৈব কৃষির এক চর্চিত দেশ হয়ে উঠুক।
- এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আরেকটি কারণ ছিল, আমদানি কমানো।
- দেশে কৃত্রিম সার ও কীটনাশক আমদানি করা হয়।
- সরকার কৃত্রিম সার ও কীটনাশক আমদানি নিষিদ্ধ করে কিছু অর্থ সাশ্রয়ের চিন্তা করেছে।
বিশ্ব পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এই ভাবনার সমাদর করা প্রয়োজন। কিছু রাজনীতিবিদ ভক্তদের দ্বারা এই ধরনের সিদ্ধান্ত সাহসী হিসাবে প্রশংসিত হয়। কিন্তু এই আকস্মিক, সাহসী সিদ্ধান্তগুলি প্রায়শই কোন চিন্তাভাবনা ছাড়া অবিবেচকের মতো হয়। আসলে দেশের প্রকৃত পরিবর্তন ঘটে ধীরে ধীরে এবং পরিকল্পনার মাধ্যমে। জৈব কৃষি ও খাদ্য সম্পর্কে দ্রব্যাদি পরিবেশের জন্য ভাল, আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, এটি টেকসইও বটে। কিন্তু যখন এটি জৈব চাষের ক্ষেত্রে আসে, তখন এর স্বল্পমেয়াদী দক্ষতা ভাল নয়।
বলা হয় যে সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করার কারণে স্বল্প মেয়াদে, উৎপাদন ২০% থেকে ৩০% কমে যেতে পারে। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে ঠিক তাই ঘটেছে। শ্রীলঙ্কা ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশ ছিল। চাল আমদানি করতে হতো না। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার পর ৬ মাসের মধ্যে চাল আমদানিতে সরকারকে খরচ করতে হয়েছে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার। শ্রীলঙ্কায় যথেষ্ট চা উৎপাদন হতো, চা অন্যান্য দেশে রপ্তানি হতো। সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার একটি প্রধান উৎস ছিল চা রপ্তানি। নিষেধাজ্ঞায় চা উৎপাদনও যথেষ্ট বাধাপ্রাপ্ত হ্যেছে।
জৈব কৃষির উপযোগিতা-
তবে এই ধারনা ঠিক নয় যে জৈব চাষে স্যুইচ করা ভুল সিদ্ধান্ত। জৈব চাষ অবশ্যই আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ভাল, পরিবেশের জন্য ভাল। তবে যে কোনও সিদ্ধান্তের পিছনে উদ্দেশ্য যতই ভাল হোক না কেন, যদি এটি সঠিক পরিকল্পনা মাফিক চিন্তা না করে করা হয় তাহল তা সাংঘাতিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে। উদাহরণ হিসাবে সিকিমের নাম আসা উচিত। ভারতে, সিকিম একটি ১০০% জৈব দ্রব্য ব্যবহার্য রাজ্য। সঠিক পরিকল্পনা ও দীর্ঘ প্রয়োগের পর সিকিম ১০০% জৈব দ্রব্য ব্যবহার্য রাজ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। তারা ২০০৩ সালে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। এবং 2016 সালে, তারা ঘোষণা করেছিল যে সিকিম একটি ১০০% জৈব রাজ্যে পরিণত হয়েছে।
স্বল্পমেয়াদে, কিছু ক্ষেত্রে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা কমে গেছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে দেখা যাচ্ছে যে উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। প্রকৃতপক্ষে, এটি সিকিমের পর্যটনকেও উত্সাহিত করেছিল।
খাদ্য মাফিয়া-
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের আরেকটি কারণ খাদ্য মাফিয়া। সরকারের দাবি, খাদ্য মাফিয়ারা খাদ্য মজুদ করছে, এমনকি মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রেরও কালোবাজারি রয়েছে। চাল, চিনি, মশলা ও ডাল ইত্যাদি। যেকোন দেশের মতো সুযোগ সন্ধানীরা সুযোগ খুঁজে সাধারণদের কিভাবে বিপদে ফেলে শ্রীলংকাও তার ব্যতীক্রম নয়। অনোইতিক মজুত করে বাজারে কৃত্রিম যোগান হ্রাস সৃষ্টি করা এদের কাজ।
বৈদেশিক ঋণের ফাঁদ-
অবশেষে চূড়ান্ত কারণ হিসাবে বৈদেশিক ঋণ শ্রীলঙ্কাকে একেবারে পর্যুদস্তের শেষ সীমায় এনে ফেলে। এটি কোনো নতুন সমস্যা নয়. ঐতিহাসিকভাবে শ্রীলঙ্কার জন্য এটি সবসময়ই একটি প্রবল সমস্যা। 2017 সালে, শ্রীলঙ্কার মোট ঋণ ছিল $৬৪ বিলিয়ন। সরকারের রাজস্বের ৯৫ শতাংশই চলে গেছে ঋণ পরিশোধে। 2020 সালে, ঋণ ছিল $৫১ বিলিয়ন, এবং শ্রীলঙ্কা এই ঋণ পরিশোধের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার উপর আমদানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এর জন্য চীনের অনেকাংশে হাত রয়েছে।
অনেকক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে চীন ঋণ-ফাঁদ কূটনীতি ব্যবহার করছে। চীন দেশগুলোকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয় যাতে তারা উন্নয়ন করতে পারে। মহাসড়ক, বন্দর, বিমানবন্দরের জন্য বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ইত্যাদি করার জন্য এই ঋণ দিয়ে থাকে। যখন অন্য দেশ তা থেকে লাভ করতে পারে না, ফলে তারা ঋণ পরিশোধ করতেও পারে না। তখন চীন প্রকল্পটি বাজেয়াপ্ত করে। চীনা কোম্পানিগুলো এই প্রকল্পগুলির দখল করে নেয়।
এর একটি বড় উদাহরণ হল শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা আন্তর্জাতিক বন্দর। এটি নভেম্বর 2010 সালে $1.3 বিলিয়ন ব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল চীন থেকে ঋণ নিয়ে। কিন্তু এ বন্দরকে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। সেই ঋণ শোধ করতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। এ কারণেই নতুন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে বন্দরের 80% অংশীদারিত্ব বেসরকারিকরণ করা হবে ও বেসরকারী কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়েছে। দরপত্রের পর বন্দরের শেয়ার কিনল কোন কোম্পানি?
চায়না মার্চেন্টস পোর্ট নামে একটি চীনা কোম্পানি। আলোচনার পর, জুলাই 2017 সালে, এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। 70% অংশীদারি চীন মার্চেন্টস পোর্টকে বিক্রি করা হয়েছিল। উপরন্তু, এই বন্দরটি এই কোম্পানির কাছে 99-বছরের লিজে দেওয়া হয়। বিনিময়ে শ্রীলঙ্কা $1.2 বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা পেয়েছে। অনেক সমালোচক এবং বিরোধী রাজনীতিবিদ এর বিরোধিতা করেছিলেন। তারা সরকারকে দেশ বিক্রির বিরুদ্ধে কঠোরভাবে স্মালোচনা করে।
শ্রীলঙ্কান টাকার অবমূল্যায়ণ-
এসব কারণেই শ্রীলঙ্কান টাকার মান দ্রুত অবনতি হচ্ছে। মার্চের শুরুতে, $১ ছিল প্রায় ২০০ শ্রীলঙ্কান টাকা। এখন, রূপান্তরের হার $১-তে নেমে এসেছে প্রায় ৩০০। কারণ তাদের মুদ্রার মান কমছে, তারা যা আমদানি করে, সবই ক্রমশ ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। ফলত মুদ্রাস্ফীতি ঘটাযর রাস্তাকে ত্বরাণ্বিত করছে।
পরিস্থিতির সর্বশেষ আপডেট হচ্ছে শ্রীলঙ্কা সরকারের সব মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সরকারের ২৬ মন্ত্রীর সবাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। কিন্তু তাদের প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাক্ষে এবং তার ভাই দেশের রাষ্ট্রপতি, যাদের বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে, তারা কেউই পদত্যাগ করেননি। মানুষ ক্ষিপ্ত, মানুষ কারফিউ অমান্য করতে রাস্তায় নেমে আসছে।
শ্রীলঙ্কাকে যে ক্রেডিট লাইন দেওয়া হচ্ছে, তা শ্রীলঙ্কাকে সফলভাবে পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করবে। এবং এর অর্থনীতিকে সুস্থ ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে। যেকোনো দেশের জন্য, সংকট এবং অস্থিতিশীলতা তার নাগরিকদের জন্য স্পষ্টতই খারাপ, তবে এটি প্রতিবেশী দেশগুলিতেও প্রভাব ফেলে।
ভারতে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির প্রভাব-
শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকলে ভারতে আরও শ্রীলঙ্কান শরণার্থী আসবে। ভারতেও এর বেশ কিছু প্রভাব পড়তে পারে। একদিকে ঐ শরণার্থীদের ভ্রণপোষনের খরচ অন্যদিকে শ্রীলঙ্কাকে সরাসরি ঋণ অথবা অন্যান্য সামগ্রি দিয়ে সাহায্যও ভারতের উপর প্রভাব পড়তে পারে।
মতামত কাম্য। ধন্যবাদ।