জাতীয় ঐক্য দিবস বা National Unity Day ও জাতীয় সংহতি দিবস বা National Integration Day-র প্রাক্কালে পুনরায় নতুন করে জাতীয় সংহতি ও ঐক্য বিষয়ে সম্যক আলোকপাত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জাতীয় সংহতি যার ইংরেজি নাম national integration সম্বন্ধে আমরা সকলেই অল্পবিস্তর অবগত। তা সত্ত্বেও সে অবগতির ভান্ডারে নতুন করে একটু ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। কেননা এর মধ্যেই রয়েছে ভারতীয় জাতীর সংকট মোচন এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রকহর মূলমন্ত্র।
এই রচনাটি National Unity Day বা National Integration Day বা জাতীয় সংহতি দিবস বা জাতীয় ঐক্য দিবস নিবন্ধ হিসাবে ছাত্রছাত্রীরা ব্যবহার করতে পারে। এরজনী আমাদের সাইটটির কোনরকম বাধা বা প্রতিবন্ধকতা থাকবে না।
অন্যদিকে সংহতি ও ঐক্য একে অপরের পরিপূরক। সংহতি শব্দটির মধ্যে সূচিত আছে ঐক্য, একাত্মতা, টান, নিবিড়তা ইত্যাদি। ঐক্যের মধ্যেও একাত্মতা, সংঘবদ্ধতা, মিলনের সীমাহীন বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তা জুড়ে আছে।
জাতি সম্বন্ধে ধারণা-
জাতীয় সংহতির( National Integration) পূর্বে জাতি সম্বন্ধে জানা প্রয়োজন। সাধারণভাবে জাতি বলতে আমরা হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদিকে বুঝি। আবার হিন্দুদের মধ্যে যে বর্ণভেদ- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই বর্ণগুলোকে আমরা জাতি বলে থাকি।
কিন্তু এসবই আমাদের ভুল ধারণা। ভুল ধারনার বহন করে আমরা ভুল জীবনযাপন করছি। ভুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। ভুল সরলীকরণ জীবনে কেবল জটিলতা সৃষ্টি করে না বরং জীবনকে অসহনীয় করে তোলে।
জাতি কাকে বলব?-
একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সকল জনগণ জীবনযাপনের সাধারণী বস্তু সামগ্রী ব্যবহার, প্রয়োগ সম্পন্ন হলে সেই জনগণকে একটি জাতি বলা হয়। তবে কেবলমাত্র বস্তু সামগ্রী নয়, অপার্থিব বিমুর্ত সামগ্রীও জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। বস্তু-সামগ্রীর মধ্যে থাকে খাদ্য, পোশাক ইত্যাদি। অপার্থিব বিমুর্ত বিষয়ের মধ্যে আছে গুরুগম্ভীর বিষয়। যেমন- আবেগ, প্রেম, ভালোবাসা।
সাধারণভাবে জাতি বলতে একটি নির্দিষ্ট দেশের মধ্যে বসবাসকারী সমগ্র জনগণই আখ্যায়িত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ভারতবাসী, বাংলাদেশী, আমেরিকান ইত্যাদি।
এখন এই মুহূর্তে প্রশ্ন স্বাভাবিক- বাংলাদেশ, আমেরিকান, রাশিয়ান সবাই না হয় এক একটি জাতি হলো, কিন্তু ভারতবাসীকে কি জাতি বলবো?
প্রশ্ন আসা অস্বাভাবিক নয়। কেননা ভারতের নানা প্রান্তে নানা ভাষাভাষী মানুষ বসবাসের সাথে সাথেই খাদ্য, বস্ত্র জীবনযাপনের নানান পার্থক্য সূচিত হচ্ছে। কিন্তু ভালো ভাসায় এগুলোকে পার্থক্য না বলে বৈচিত্র বলা হয়ে থাকে। এই বৈচিত্র্ ভারতের এবং ভারতবাসীরা অনন্য বৈশিষ্ট্য। ভারতবাসী মধ্যে এই বৈচিত্রের সাথে সবচেয়ে প্রভাবশালী যে বিষয়টি কাজ করে তা হল প্রেম-ভালোবাসা এবং ভারতবাসী হিসেবে আবেগ। যার কারণে আমরা এই ভূখণ্ডে একে অপরের পাশে থাকি এবং ভারতবাসী হিসেবে গর্ব অনুভব করি।
সংহতি কি-
কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাট থেকে অরুণাচল এই প্রশস্ত ভূখণ্ডের মধ্যে আছে নানান ভাষা, নানা মত, নানা খাদ্য, বস্ত্র বাসস্থানের ধরন। সেইসঙ্গে জীবনযাপনেরও নানা বৈচিত্র্য। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোন বিষয়ে জয়লাভ যেমন গুজরাটবাসীকে আনন্দ দেয়, সেরকম বাঙালি, কাশ্মীরি সকল মানুষ একসাথে আনন্দে মাতোয়ারা। সকলে সমবেত কণ্ঠে বলে ওঠে- জয় হিন্দ। একে বলে দেশপ্রেম। যার মিলনমেলায় সৃষ্টি হয় সংহতি।
সংহতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকে একাত্মতা। একাত্মতার মধ্যে সৃষ্টি হয় এক আবেগীয় তোরণ। যার সঙ্গে থাকে এক অদম্য শক্তি। মিলেমিশে কাজ করার বাসনা এবং এক সূত্রে বেঁধে থাকার মানসিক প্রচেষ্টা। এর থেকে আসে ঐক্য। এক জাতির মধ্যে ঐক্য বিরাজমান হলে তাকে আমরা জাতীয় ঐক্য(National Unity) হিসেবে চিহ্নিত করি। এ সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলি একটি জাতিকে করে তোলে অনন্য এবং সুস্থ প্রতিযোগিতা নেমে মাথা উঁচু করে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা।
ভারতবর্ষের জাতীয় সংহতি | জাতীয় ঐক্য | National integration | National unity-
ভারতবর্ষের জাতীয় সংহতি ও ঐক্য অন্যান্য জাতীয় সংহতির তুলনায় অনেক পার্থক্য পূর্বেই বলেছি। ভাষা, খাদ্য, পোশাক জীবনযাপনকে পাল্টায়। পাল্টায় সংস্কৃতিকে। অন্যান্য দেশে যেখানে পার্থক্য খুব একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু ভারতবর্ষের মধ্যে পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। এই পার্থক্যই ভারতবর্ষে প্রধান বৈশিষ্ট্য।
বিশাল ভূখণ্ডে ভাষা, পোশাক, খাদ্য, জীবনযাপন বদলানোর কারণ হিসেবে ভোগলিক অবস্থান ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে। পাহাড়ি এলাকা সমতলভূমি এলাকার মানুষের জীবন যাপনের পার্থক্য সূচিত হয়। তার জন্য ভৌগোলিক কারণকেউ দায়ী করা যায়। ভৌগলিক কারণ এখানকার মানুষ, জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করার সাথে সাথে পোশাক, কৃষিকাজ, জনপরিবহন, খাদ্য ইত্যাদিকে প্রত্যক্ষ ভাবে প্রভাবিত করে। মানুষের জীবনযাপনকেউ পালটে দিয়েছে। ভারতবাসীর মধ্যে পার্থক্য ভারতীয় ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণ হিসেবে সামনে আসে। তবুও সকল ভারতবাসী জাতীয় সংহতির মধ্যে এক সুতোয় গাঁথা, যা জাতীয় ঐক্যকে সূচিত করে।
তবুও অশান্তি-
প্রেম-ভালোবাসা জাতীয় সংহতির মধ্যেও ভারতবাসি কিন্তু প্রকৃত ভাবে শান্তিতে বসবাস করে না। ভাষাগত, জীবনযাপনগত, ভৌগোলিক অবস্থানগত, প্রশাসনিক কাজকর্ম চালানোর সুবিধার জন্য ভারত বর্ষ নানান রাজ্যে বিভক্ত। হিন্দি বাসীরা ভাবেন হিন্দি ভাষা আমাদের জাতীয় ভাষা। হিন্দি সবচেয়ে উত্তম ভাষা। তামিল, তেলেগু, বাংলা, অসমীয়া সেভাবেই নিজের মাতৃভাষা প্রচন্ড ভালোবাসে। নিজের ভাষার প্রতি প্রেম অন্যের ভাষাকে কখনো কখনো নিকৃষ্ট করে। সেই রকম খাদ্য পোশাকের ক্ষেত্রে তুলনা। যেমন- বাঙ্গালীদের প্রতি এক ব্যঙ্গাত্মক খেতাব আছে- ‘ভেতো বাঙালি’ হিসেবে। বাঙালিরা শুধু ভাত খায় আর ঘুমায়। স্বাভাবিকভাবেই আমরা যারা বাঙালি তাদের রাগ হওয়ার কথা। এক কথা থেকে দু’কথা, দু’কথা থেকে দশ, দশ থেকে শ’য়ে পৌঁছে শেষে হাতাহাতিও হতে পারে।
কখনও কখনও আমরা বলি- লালু প্রসাদ রেল মন্ত্রী থাকাকালীন অনেক বিহারী রেলে চাকরি পেয়েছে(শোনা কথা, সত্যতা জানা নেই)। আমাদের মনে এখনও সে বিদেশ উঠে যায় নি।
সেরকম এক রাজ্যের চাকরিপ্রার্থীরা অন্য রাজ্যে চাকরি পরীক্ষা দিতে গেলে সেখানকার স্থানীয় জনগণ পরীক্ষার্থীদের ওপর অত্যাচার চালায়। মারধর পর্যন্ত করে। এই ধরনের জাতীয় সংহতির স্বরূপ আমাদেরকে ছাড়ে না। আসামে বাঙালি নিধন আমাদের অশান্তির বাতাবরণ ভরিয়ে দেয়। অন্যদিকে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে জাতীয় ভাষা হিন্দি প্রচলনের প্রচেষ্টাও রাজ্যবাসীরা বিরোধিতা করে ঠিকই, কিন্তু ছেলেমেয়েকে ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে ভর্তি করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জাতীয় সংহতির উপর অশান্তির কারণ-
ঐক্য, জাতীয় সংহতির উপর ভারতবর্ষের অশান্তির কারণ হিসেবে যে বিষয়গুলি উঠে আসে তার মধ্যে বেকারত্ব, অভাব, শিক্ষা ও রাজনীতিকে প্রধান কারণ হিসেবে বলা যায়। যদিও এ বিষয়গুলো আঞ্চলিক বিষয় এবং সারা পৃথিবীর সমস্ত জাতির মধ্যে অল্পবিস্তর উপস্থিত। কিন্তু জাতীয় সংহতি বিষয়টিকে যদি আন্তর্জাতিক সমস্যা’ তথা নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনা করা হয়, পূর্বে উল্লেখিত সমস্ত রাজ্যগুলি কারণগুলিই তখন গৌণ হয়ে পড়ে। ধরা যাক ভারতবর্ষকে কোন দেশ আক্রমণ করল, তখন কিন্তু হিন্দিভাষী, বাংলাভাষী, অসমীয়া সহ সমস্ত ধর্মাবলম্বী মানুষ এক ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে সে সমস্যার সমাধানে বদ্ধপরিকর হই।
তাই বলা যেতে পারে হয়তো কখনও কখনও রাজ্য ভেদে, ভাষা ভেদে আমাদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি, অশান্তি সৃষ্টি হয়। অশান্তি কখনো কখনো নতুন রাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিও করে। তথাপি ভারত বর্ষ থেকে মুক্ত হওয়ার ধারণা পোষণ করা হয় না বা কেউ করেও না। আর এখানে ভারতীয় জাতীয় সংহতির ঐতিহ্য। এর মধ্যে জাতীয় ঐক্য সূচিত হয়।
জাতীয় সংহতি দিবস ও জাতীয় ঐক্য দিবস | National integration Day 2023 | National unity day 2023-
ভারতবর্ষের জাতীয় সংহতি দিবস কবে? ইন্টারনেটে সার্চ করলে যতগুলি তথ্য পাওয়া যায় তার মধ্যে বেশ অসঙ্গতি রয়েছে। বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়া মূলক নয়। কোন কোন সাইট বলছে 31 অক্টোবর ভারতের জাতীয় সংহতি দিবস। আবার 19 শে নভেম্বরকে অনেকেই জাতীয় সংহতি দিবস হিসাবে উল্লেখ করছেন। 31 শে অক্টোবর 19 শে নভেম্বর দিনদুটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। 31 অক্টোবর হলো সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের(Sardar Vallabhbhai Patel) জন্মদিন ও ইন্দিরা গান্ধীর(Indira Gandhi) মৃত্যু দিবস। অন্যদিকে 19শে নভেম্বর হল ইন্দ্রাগান্ধির জন্ম দিবস।
প্রকৃতপক্ষে 31 শে অক্টোবর হলো জাতীয় ঐক্য দিবস/National Unity day এবং 19 শে নভেম্বর হল জাতীয় সংহতি দিবস/National Integration Day।
আরো পড়ুন- The National Youth Day 2023
উপসংহার-
প্রকৃতপক্ষে সংহতি/National Integration ও ঐক্য/National Unity একে অপরের পরিপূরক। সংহতির মধ্যে সূচিত আছে ঐক্য, সংঘ, একাত্মতা, নিবিড়তা ইত্যাদি। ঐক্যের মধ্যেও আছে একাত্মতা, সমতা, সংঘবদ্ধতা, মিলনের সীমাহীন বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তা। এ এক সীমাহীন বিশাল এক মানসিক অনুভূতির ক্ষেত্র। কেবলমাত্র একদিন-দু’দিন জাতীয় সংহতি দিবস/National Integration Day Day বা জাতীয় ঐক্য দিবস/National Unity Day নয়, সারা বছর ব্যাপী ভারতীয় জাতি একাত্মতায় আবদ্ধ থাকুক। জীবনশৈলীর ধরনের ভিন্নতা নয়, বৈচিত্রকে সম্মান দিয়ে এক ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে চলতে থাকুক ভবিষ্যৎ আলোক উৎসের দিকে। জয় হিন্দ। জয় ভারত।