আজকের বিষয় হিসাবে অনিয়ন্ত্রিত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির উপর সম্যক আলোকপাতের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি(Today- we discuss about Major 12 Reasons for Abnormal Rising Prices in Essential Commodities.)। বিভিন্ন কারণের মধ্যে যেকোন দেশের যুদ্ধের প্রভাবও সমগ্র পৃথিবীতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্দির উপরেও সাংঘাতিকভাবে প্রতিফলিত হবে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রান যায়। অনেকের ধারণা রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ ভারতের মতো দেশে কোনো প্রভাব পড়বে না।
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে মাথা ব্যথার শেষ নেই। এই সমস্যা একদিনের নয় বা সাময়িক নয়। অতি প্রাচীনকাল থেকেই বিনিময় প্রথার সাথে সাথে দ্রব্যের মূল্য সামঞ্জস্য, অসামঞ্জস্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন দ্রব্যের সঙ্গে যুক্ত। টাকার মূল্য বৃদ্ধি ও হ্রাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্রব্যের মূল্য উঠানামা করছে। যেমন 10 বছর আগে সোনার যা মূল্য ছিল বর্তমানে তা নেই।
বিষয়টা পরিষ্কার করা যাক- 2009, 2010 ও 2011 সালে 24 ক্যারেট 10 গ্রাম সোনার মূল্য ছিল যথাক্রমে 14500, 18500, 26400 টাকা। বর্তমানে ওই টাকায় কতটুকু সোনা পাওয়া যায়? বিপরীতে বর্তমানে 24 ক্যারেট দশ গ্রাম সোনার মূল্য কত দিতে হয়? এর উত্তর যা পাওয়া যায় তাই হল টাকার অবমূল্যায়ন ও মুদ্রাস্ফীতি। আবার 10 বছর আগে এক কিলো পোস্তর মূল্য ছিল 400 থেকে 500 টাকা। বর্তমানে এক কিলো পোস্তর মূল্য 2400 থেকে 2500 টাকা। 400-500 টাকায় বর্তমানে যে পরিমাণ পোস্ত পাওয়া যায় তা খুবই সামান্য। অর্থাৎ টাকার মূল্য কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
Why Rising Prices in Essential Commodities | দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ-
কারণগুলো প্রত্যেকের অল্পবিস্তর একটু জানা। চায়ের দোকানে হাটে-বাজারে বাসস্ট্যান্ডে বাসে ট্রেনে- সব জায়গাতেই বিভিন্ন ধরনের মানুষের সমাগমে তাদের মধ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ নিয়ে মতবিনিময় হয়ে থাকে। যে যার মতো করে এই সমস্যার কথা গুলো ব্যক্ত করতে থাকেন। ক্ষোভ উগরে দেন বিভিন্ন সংস্থা ব্যবসায়ী, কখন কখনো সরকারের ওপর। তবে যাই হোক না কেন শুধু কোন একটি কারণের উপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাস নির্ভর করে না। এটা সকলেই অবগত। একাধিক কারণ মিলিতভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এবং স্থান বিশেষে দ্রব্যমূল্যের পার্থক্য দেখা যায়। আপনারা অনেকেই সে বিষয়ে অবগত তবুও কয়েকটা কারণ বা বিষয় নিয়ে আলোচনায় আসা যাক।
Reasons for Abnormal Rising Prices-
1-Demand | চাহিদা বৃদ্ধি-
অর্থনীতির একটা সোজা নিয়ম- চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মূল্য বৃদ্ধি পায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রত্যেকটা জিনিসের বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। প্রত্যেকটি জিনিসপত্র কিনে মানুষের নৈমিত্তিক কার্যাদি সম্পন্ন করতে হয়। সে জিনিসপত্র খাবার হতে পারে, বিনোদনের অথবা প্রসাধনী সামগ্রী যা কিছুই হোক না কেন।। বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্তরে অবস্থিত মানুষের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সংজ্ঞা বিভিন্ন। অতি নিম্নবিত্ত পরিবারের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বলতে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের প্রাধান্যই সর্বাগ্রে। অন্যদিকে সচ্ছলতার হার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকার সাথে সাথেই অন্ন বস্ত্র বাসস্থান ছেড়ে অন্যান্য বিনোদন সামগ্রী প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হয়।
তাই বলা যেতে পারে বিভিন্ন স্তরের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা রকমফের রয়েছে। কিন্তু যেহেতু চাহিদা রয়েছে, অর্থনীতিক নিয়ম অনুসারে তার মূল্য বৃদ্ধি পাবে।
2- Low Supply | যোগান হ্রাস-
শুধু চাহিদা বৃদ্ধির উপরই মূল্যবৃদ্ধি নির্ভর করে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সীমিত যোগান। চাহিদা আছে, আবার যোগানও যথেষ্ট রয়েছে সেক্ষেত্রে দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি না পেয়ে স্থির থাকে। কখনো কখনো বা হ্রাসও পায়। কিন্তু চাহিদা আছে আবার যোগানের পরিমাণ সীমিত সেক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী।
লকডাউনের সময় বিভিন্ন রাজ্য থেকে যে সমস্ত দ্রব্যাদি আসার কথা তার যোগান অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করাও মুশকিল হয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্য মানুষের হাতের নাগালের বাইরে ছিল।
বর্তমানে সাময়িকভাবে অথবা দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্ন দ্রব্যের যোগান হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথেই দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। যে সমস্ত মাছ আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বাইরে থেকে আসে কোন কারনে তার যোগান হ্রাস পেলে, একদিন দুদিনের জন্য হঠাৎ করে মাছের দর বৃদ্ধি পেয়ে যায়। উদাহরণ হিসাবে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে রাশিয়া অন্যান্য দেশ থেকে যেমন দ্রব্যাদি আমদানি করতে পারছে না, সে রকম রাশিয়াও অন্যান্য দেশে তার দ্রব্যাদি রপ্তানি করবে না। ফলে সে দেশগুলিতেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ত্বরাণ্বতি হওয়া স্বাভাবিক।
3- Rising of Production Cost | উৎপাদন মূল্য বৃদ্ধি-
উৎপাদন মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে যে কোন দ্রব্যের বিক্রয় মূল্য বৃদ্ধি পায়। কোন একটি দ্রব্যের উৎপাদন বিভিন্ন অংশের মিলিত সমাহার। যেমন কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত থাকে- বীজ, সার, কীটনাশক, যন্ত্রপাতির ব্যবহার, সেচ ব্যবস্থা এবং শ্রমিকের মজুরি। এই বিষয়গুলি এক বা একাধিক অংশের মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে দ্রব্যের বিক্রয় মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বিশেষ করে সার কীটনাশক দ্রব্য এবং সেচের জন্য ইলেকট্রিক বিল অথবা পেট্রোলিয়ামের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন মূল্য প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ফলস্বরূপ কৃষিজাত দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। কৃষিজাত পণ্য সামগ্রী এমন এক ধরনের দ্রব্য যা প্রতিটি মানুষের- উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত প্রত্যেকেরই প্রয়োজন। অতএব এই সমস্ত দ্রব্যের বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
4- Products Enter into the Market Indirectly | দ্রব্যের পরোক্ষভাবে বাজারে আসা-
যেকোনো ধরনের দ্রব্য কৃষিজাত হোক বা শিল্পজাত সামগ্রী সরাসরি কখনো বাজারে আসে না। কৃষিজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে কৃষক খুব কম পরিমাণ উৎপাদিত দ্রব্য বাজারে নিয়ে আসে। গ্রামগঞ্জে ছাড়া মফস্বল শহর থেকে শুরু করে মেট্রোপলিটন সিটি প্রত্যেকটা জায়গাতেই কৃষক সরাসরি সে দ্রব্য বাজারে আনতে পারে না। কৃষক কোন ব্যবসাদার কে সে দ্রব্য বিক্রি করে। ব্যবসাদার আবার কোন ছোট ব্যবসাদার কে এবং সবশেষে খুচরো কারবারিকে ওই দ্রব্য বিক্রি করার পর সেটি বাজারে আসে।
কখনো কখনো বড় বড় কোম্পানি সাপ্লাইয়ের কাছ থেকে কৃষিজাত দ্রব্য ক্রয় করে ধীরে ধীরে বাজারে নিয়ে আসে কৃষিজাত দ্রব্য কৃষক থেকে শুরু করে যতগুলি স্তর পেরিয়ে বাজারে আসে প্রত্যেকটা স্তরের ব্যবসাদাররা ওই সামগ্রীর ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ রাখে। স্বভাবতই সাধারণ ক্রেতা বাজার থেকে দ্রব্য কিনলে তার দাম যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়ে যায়।
শিল্পজাত সামগ্রীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কারখানায় প্রস্তুত হওয়ার পর কোন দ্রব্য বড়-ছোট ডিলার থেকে ব্যবসায়ী, সেখান থেকে ছোট ব্যবসায়ী এবং সবশেষে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে আসে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই হাইকমিশন না হলে নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ সেই উৎপাদিত দ্রব্যের উপর বসতে থাকে। স্বভাবতই সাধারণ দ্রব্য কেনার সাথে সাথে তার মূল্য যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয় সরকারি জিএসটি।
5- Misguidance of GST | জিএসটির ভুল ব্যাখ্যা-
পূর্বে দ্রব্য মূল্যের উপর বিভিন্ন ধরনের টেক্স চাপতো। যেমন-ভ্যাট। বিভিন্ন স্তরে ক্রয় মূল্যের উপর লাভ যুক্ত হয়ে বিক্রয় মূল্য এবং তার ওপরে ভ্যাট বসতে বসতে দ্রব্যের মূল্যে যথেষ্ট বেড়ে যেত। বর্তমানে সমস্ত দ্রব্যের উপর একটি ট্যাক্স ধার্য হয়, সেটি হলো জিএসটি। জিএসটি চালু হবার সাথে সাথে কিছু দ্রব্বের মূল্য যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে। তেমনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্রব্যের মূল্য হ্রাস পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখেছি জিএসটি চালু হওয়ার পর বেশিরভাগ দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
যেমন গম, চাল, নন-ব্র্যান্ডেড ময়দা, দই, মাখন, দুধ নন-ব্র্যান্ডেড মধু এগুলোর পূর্বে ছিল 2.5-6% পার্সেন্ট পর্যন্ত ট্যাক্স। বর্তমানে এদের উপর কোন জিএসটি নেই- 0% জিএসটি। এদের মূল্য কমে যাওয়ার কথা, কিন্তু তার ফলাফল আমরা দেখেছি কি?
1000 টাকা দামের কম মূল্যের জামা কাপড়ের উপর বর্তমানে 5% জিএসটি। এর সুবিধা ও আমরা পাইনি।
6- Transportation Cost | পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি-
পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সরাসরি নিয়ন্ত্রিত হয়। পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি নির্ভর করে জ্বালানির দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি হ্রাসের ওপর। প্রত্যক্ষভাবে পেট্রোল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। উড়োজাহাজ, জাহাজ, রেল বা সড়ক পরিবহন মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে যে কোন দ্রব্যের মূল্যও বৃদ্ধি পাবে।
পেট্রোলিয়ামের মূল্য বৃদ্ধি হ্রাসের সাথে সাথেই উৎপাদনের মূল্য নির্ভর করে। কৃষক জমিতে চাষ দেওয়ার যন্ত্র ব্যবহার করলে অথবা সেচের জন্য পাম্প ব্যবহার করলেও উৎপাদন মূল্য বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে শিল্পজাত দ্রব্য সামগ্রী বাজারে পাঠানোর জন্য বা কাঁচামাল কারখানায় আনার জন্য পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এ কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক।
7- Artificial Crisis | Non-controlled Stock | অনিয়ন্ত্রিত মজুদ | কৃত্রিম ঘাটতি-
বিভিন্ন ধরনের দ্রব্য অনিয়ন্ত্রিত মজুদ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে তরান্বিত করে বিভিন্ন গোপন স্থানে অসৎ মজুমদাররা দ্রব্য বন্ধ করে রাখে এবং বাজারে একটা কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি করে। এসব অসৎ ব্যবসায়ীরা, মজুতদাররা সবসময় চায় তারাই সবচেয়ে বেশি লাভ করবে। বাজারে অন্যান্য ব্যবসাদারদের কোনভাবেই সেই লাভের বিন্দুমাত্র অংশ ভোগ করতে দেবে না। অনিয়ন্ত্রিত হারে মজুদ সৃষ্টি হলে কৃত্রিম ঘাটতি স্বাভাবিকতাকে রোধ করার মত ক্ষমতা সাধারন মানুষের থাকে না। কখনো কখনো বিক্ষোভ হয় ঠিকই কিন্তু তা সফল না হলে ঘাটতি থেকেই যাবে। মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকবে। অবশেষে সরকারি হস্তক্ষেপে এই নিয়ন্ত্রণ ভঙ্গ হলে স্বাভাবিকতা ফিরে এলো মানুষের ক্ষতির পরিমাণ কমলেও 100% সমাধান কোনভাবে সম্ভব হয়ে ওঠেনা।
8- Corporate System-
কর্পোরেট সংস্থা বা কর্পোরেট ব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা সকলেই এই যুগে অবগত। কিন্তু কর্পোরেট ব্যবস্থা বা সংস্থা কি? সে সম্বন্ধে অনেকেই ওয়াকিবহাল নয়। আমরা জানি বড় বড় কোম্পানিগুলো কর্পোরেট সংস্থা এবং ব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত- তা ঠিক কথা।
কর্পোরেট সংস্থা কি? কর্পোরেট সংস্থা হল সেই সংস্থা যারা একটি নির্দিষ্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের লাভের অংক একে অপরের উপর নির্ভর করে বুদ্ধি করে চলে। ওটা কোন একটি স্তরে তার নির্দিষ্ট টার্গেট সম্পন্ন না হলে তার প্রভাব উপরের স্তরে পড়বে। কিছুতেই তার ইন্সেন্টিভ পাবে না। কোম্পানির নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয় তা পৌছাবে না। কর্পোরেট সংস্থার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট মুনাফার লাভ এর লক্ষ্যমাত্রা পূর্ব থেকে ধার্য করে দেওয়া এবং সেই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর জন্য একটি ব্যবস্থা সৃষ্টি করা, সেটি হল কর্পোরেট ব্যবস্থা।
অতএব বলতে পারি কর্পোরেট ব্যবস্থার মধ্যে প্রত্যেকটি স্তরের কোন একটি দ্রব্যের নির্দিষ্ট লাভ কোম্পানির লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। কোম্পানি কখনোই লোকসান চায় না। যেহেতু বিভিন্ন স্তরে কোম্পানিতে তার লাভের অংক বন্টন করতে হয় স্বাভাবিক ভাবেই কোন একটি দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বেশিরভাগই বর্তমান কর্পোরেট ব্যবস্থায় বাজারে বিক্রির হয়। স্বাভাবিকভাবে সেই দ্রব্যের দাম বা মূল্য অনেক বেশি হয়।
9- Illegal Money Collection from the Traders | অনৈতিকভাবে তোলা আদায়-
ব্যবসাদারদের অনেক সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে তোলা দিতে হয়। এই ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট স্থানীয় দুষ্কৃতী প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। এক বা একাধিক দল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিভিন্ন হারে নিত্যনৈমিত্তিক মাসোহারা আদায় করে থাকে। ব্যবসাদারদের যেহেতু এ সমস্ত টাকাগুলো বাড়তি খরচ, সেই খরচ বা লোকসান তোলার জন্য দ্রব্য মূল্যের উপর অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ করতে বাধ্য হয়। স্বভাবতই নৈমিত্তিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। তোলা আদায় নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হয়ে পড়ে।
শুধু রাজনৈতিক মদদপুষ্ট দুষ্কৃতিরাই নয়, পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত যানবাহন থেকে পুলিশরাও হাত বাড়িয়ে তোলা আদায় করে থাকে। ড্রাইভার মালিকরা পুলিশদের তোলা না দিলে আইনিভাবে পুলিশের পক্ষ থেকে লরির মালিক এবং ড্রাইভারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়। অথবা হুমকিও দেওয়া হয়। স্বভাবতই লরি মালিক বা ড্রাইভাররা আইনি জটিলতার মধ্যে না গিয়ে পুলিশদের তোলা দিতে বাধ্য হয়। পরিবহন মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে, স্বভাবতই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিশ্চিত।
10- Inflation | মুদ্রাস্ফীতি-
আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় নোটের মুদ্রাস্ফীতি ঘটলে তা তার অবমূল্যায়ন করতে বাধ্য হয। টাকার মূল্য কমে গেলে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি অনিবার্য। অন্যদিকে দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটে। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে মানুষের হাতে অতিরিক্ত টাকা চলে এলও চাহিদা বৃদ্ধি পায়। তার সঙ্গে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক্ষেত্রেও টাকার অবমূল্যায়ন বা মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়।
অতএব আমরা বলতে পারি হাতে বেশি পরিমাণ টাকা এলেও যেমন দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতিও ঘটে। একে উভমুখী ঘটনা বলা যেতে পারে।
11- Advertising Cost | বিজ্ঞাপনের খরচ-
বিভিন্ন ধরনের পণ্য, তার মধ্যে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য রয়েছে। যেগুলো বিভিন্ন কোম্পানি দ্বারা বাজারে সরবরাহ হয়ে থাকে এবং সেখান থেকে খুচরো গ্রাহকরা কিনে ব্যবহার করেন। এরকম ধরনের বিভিন্ন দ্রব্যের ওপর কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেয়। বিজ্ঞাপনের জন্য প্রচুর পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ করে। বিশেষ করে কোন সেলিব্রেটি বা তারকারা সেই বিজ্ঞাপন দিলে কোম্পানির কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ নিয়ে থাকে। স্বভাবতই কোম্পানি ওই দ্রব্যটির মূল্য স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধি করে। একটি নির্দিষ্ট মূল্যকে নির্ধারণ করে যেটি বিজ্ঞাপন না দিলে, দ্রব্যের মূল্য অনেক অংশে কম হতো।
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ | Russia Ukraine War-
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ সারা পৃথিবী ব্যাপী সাংঘাতিক প্রভাব ফেলেছে এবং আগামীতে আর ফেলবে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশ রাশিয়ার উপর নানান নিষেধাজ্ঞা জারি করার ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি অনেকটাই পর্যুদস্ত। অনেকের ধারনা কেবলমাত্র ইউকেনেরই ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মত রাশিয়ার জনসাধারণও এক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রুবেলের মূল্য এতটাই কমেছে যে রাশিয়ানরা অন্য দেশের স্যালারি নিতে ভয় পাচ্ছে। যুদ্ধের দরুন রুবেলের মূল্য হ্রাস, বর্তমান 1 ডলার= 123-135 রুবেল হয়ে গেছে। গত দু’সপ্তাহ পূর্বে যেখানে 1 Dollar= 70-72 রুবেল ছিল।
তাছাড়া রাশিয়ার সাথে বিভিন্ন দেশ বৈদেশিক অর্থনৈতিক কারবার বন্ধ করেছে। Visa, Master Card রাশিয়াতে বন্ধ রয়েছে। অন্যান্য দেশ রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধ করায় রাশিয়া মুখ থুবড়ে পড়ার সাথে সাথে রাশিয়া যে দেশগুলিতে দ্রব্যাদি রপ্তানি করতো সে দেশগুলিতে রপ্তানি পুরোপুরি স্থগিত হবেই। স্বভাবতই সে দেশের দ্রব্যের ঘাটতি দেখা দেওয়ার মধ্য দিয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পথকে দ্রুত ত্বরাণ্বিত করবে।
বর্তমান শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত সাংঘাতিক। জনগণ এক সংকটময় সময়ের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছে। দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া। প্রাথমিক চাহিদাটুকু মেটানোই এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। কী এমন ঘটলো যাতে শ্রীলঙ্কা এমন শোচনীয় অবস্থার সম্মুখীন? রাষ্ট্র হিসাবে দুর্বল, পরনির্ভরশীলতা, রাষ্ট্রনেতাদের কিছু অবিবেচক নীতি ও অন্যান্য কিছু কারণ শ্রীলঙ্কাকে করেছে পর্যুদস্ত। এখানে ক্লিক করে জানুন শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণ। |
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা-
উপরিউক্ত বিভিন্ন কারণ ছাড়াও আরো অনেক প্রত্যক্ষ, অপ্রত্যক্ষ, মানসিক এবং সরকারি কারণ রয়েছে, যে কারণেও দ্রব্যমূল্যে বৃদ্ধি অনিবার্য।
অন্যদিকে মুনাফার ওপর সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ নেই। তোলা আদায়ের ওপর সরকারের আইন থাকলেও কড়াকড়ি বাধা-নিষেধ নেই। কোন দ্রব্যের উপর প্রকৃত উৎপাদন মূল্য খরিদ্দারকে এবং সরকারকে জানানোর কোন পদ্ধতি নেই। সরকারের জানার কোন আগ্রহও নেই। ফলস্বরূপ অনিয়ন্ত্রিত পণ্য উৎপাদন এবং তার ব্যবসা চলছে যার মাধ্যমে খরিদ্দার নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
উপরের উল্লিখিত কারণগুলির গোড়া সমূলে বিনাশ করলেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। কিন্তু সমগ্র বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হয় সরকার দ্বারা। এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সকলের রোজগার। কোন এক স্থানে নিয়ন্ত্রণ করলে সমস্যা হ্রাস পাওয়ার তুলনায় সমস্যা বৃদ্ধি পেয়ে কোন একটি স্তরের জনগণ ভোগ থেকে বঞ্চিত হবে। প্রয়োজন এক স্বয়ংক্রিয় সমগ্র পদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি।
একক মানুষ হিসাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা একেবারেই নেই বললেই চলে। তবে একক ব্যক্তি হিসাবে আপনার প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্রয় নিয়ন্ত্রণ করতেই পারেন। প্রয়োজনে ন্যূনতম ক্রয় ছাড়া অতিরিক্ত দ্রব্য কেনা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। এ এক কঠিন কার্যপ্রণালী, কোনো ক্ষেত্রে হাস্যকর পর্যায়েও চলে যেতে পারে। অনেকটা কৃচ্ছসাধনের মতো ব্যাপার দাঁড়ায়। তথাপি নিচের কিছ পদ্ধতিগুলি নিয়ে মতামত দেওয়া যেতে পারে।
ব্যক্তি এবং রাষ্ট্র উভয়ের ক্ষেত্রেই এই কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। নিজেদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিজেরাই উৎপাদন করলে বা তৈরি করে নিলে সমস্যা অনেকটাই মিটে যায়। দেশ অতিরিক্ত দ্রব্যাদি উৎপাদনের সাথে সাথে বাইরে রপ্তানির পথকে প্রশস্ত করতে পারলে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে মুল্য হ্রাস পাবার সম্ভাবনাও তৈরি হবে। তবে একশ শতাংশ আত্ম-নির্ভর হওয়াও একেবারে অসম্ভব।
মানসিক কারণ-
মানসিক কারণগুলোর মধ্যে অতিরিক্ত লোভ উল্লেখ করা যেতে পারে। এই রোগ হলো অতিরিক্ত মুনাফা বৃদ্ধির আকাশছোঁয়া মনোভাব। অল্প সময়ে বেশি পরিমাণ অর্থ মুনাফার উদ্দেশ্যে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটে থাকে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরের মানুষ অনির্দিষ্ট হারে মুনাফা বৃদ্ধি করতে চায়। অতিরিক্ত লোভ, অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জনের মানসিকতাও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পথকে মসৃন করে। লোভ লালসা অসততা ইত্যাদি মানসিক রিপুকে দূর করার ও নিয়ন্ত্রণের নৈতিক শিক্ষার অভাব সমাজকে গ্রাস করছে। এর কারণ হিসাবে ধণের অসাম্য ও অস্তিত্ত্ব রক্ষার সংকটকে অবহেলা করার কোন স্থান নেই।
আপনাদের কাছ থেকে আমরাও জানার অপেক্ষায় রইলাম। কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে আপনদের মতামতের আশায় আছি। ধন্যবাদ।
Read More- পেট্রোলের দাম বৃদ্ধি- সামাজিক প্রভাব। |